হোন্ডা মোটর করপোরেশন সম্পর্কে আমরা সকলেই কম-বেশি অবগত আছি। পৃথিবীর ৫ম বৃহৎ এই অটোমোবিল কোম্পানি সারা পৃথিবীতে নিজেদের ব্যবসা প্রসারণ ও পরিচালনা করে চলেছে নিয়মিত। বাংলাদেশে আসার পর হোন্ডা এতোটাই গ্রহণযোগ্যতা পায় যে, এখানে মোটরবাইকের অপর নাম হয়ে যায় হোন্ডা। বাংলাদেশের মানুষ মোটরবাইক না বলে হোন্ডা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তবে এতো বড় ও জনপ্রিয় কোম্পানির যাত্রা কিভাবে শুরু হয়েছিল তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? হোন্ডার রয়েছে প্রায় ৭৬ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও অঢেল রেকর্ড। তাই, আজকের লেখায় আমরা বিখ্যাত গাড়ি কোম্পানি হোন্ডা মোটরসের উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।
হোন্ডা মোটরসের যাত্রা
সাল ১৯৪৬। মাত্র গতবছরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা শেষ হয়েছে জাপানে। যুদ্ধের কারণে জাপানের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ শহর ও উৎপাদনশীল কারখানা এখন পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপ। যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত জনজীবন এখনো পুরোদমে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। তবে এই ধ্বংসস্তুপ থেকেই ফিনিক্স পাখির মতো নতুন জাপান গড়ে তোলার অঙ্গিকার করে ফেলেছেন তারা। তাই যার যা সামর্থ্য আছে, তা দিয়েই চেষ্টা করে চলেছেন যুদ্ধে বিপর্যস্ত শহরগুলোকে আবার পুরনো রুপে ফিরিয়ে আনতে। ঠিক এমন সময়েই জাপানের হামামাতসু শহরের একটি কারখানার নেতৃত্ব নিয়ে নিলেন Sochiro Hondo, যাকে আমরা এখন জানি বিখ্যাত হোন্ডা মোটরস করপোরেশনের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে।
যুদ্ধের কারণে কারখানাটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাই এখানে কাজ করা ছিল অনেক কঠিন ব্যাপার। তবে সফল হওয়ার জন্য মরীয়া সোচিরো হোন্ডা এখানেই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন হোন্ডা টেকনিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট। উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিভিন্ন ধরণের পণ্য কিভাবে উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে রিসার্চ করা এবং নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন করা।
সোচিরো হোন্ডার প্রাথমিক প্রচেষ্টা
কারখানায় সোচিরো হোন্ডা সর্বপ্রথম উৎপাদন করেন “Rotary Weaving Machine”। তারপর তিনি ব্যাপকভাবে “Frosted Glass Window” উৎপাদনের চেষ্টা চালান। কারণ, অল্প অল্প করে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে লাভ করা সম্ভব নয়। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে, তিনি যদি আসলেই লাভ করতে চান তাহলে তাকে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু তার প্রথম দুটি পণ্যই অসফল থেকে যায়। তিনি বাজার ধরতে পারছিলেন না কোনোভাবেই।
দমে না গিয়ে পরবর্তীতে তিনি “Woven Bamboo Roof Panel” উৎপাদন শুরু করেন। তার কিছু সময় পরেই তিনি ফ্যাক্টরিতে একটি 2-Cycle Motor আবিষ্কার করেন। তিনি যাতায়াতের জন্য যেহেতু গ্যাসোলিন পাওয়া তখন অনেক কষ্টকর, তাই সেটার পূর্ণ ব্যবহার তিনি করতে পারছিলেন না। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ঠিক করলেন যে তিনি এফিশিয়েন্ট মোটরবাইক তৈরি করবেন, যা দিয়েই খুব গ্যাসোলিনেই যাতায়াত করা সম্ভব হবে।
প্রথম মোটরবাইক উৎপাদন
2-Cycle Motor গুলোকে তিনি কিছুটা মোডিফাই করেন যাতে করে তা খুব সহজেই সাইকেলের সাথে জুড়ে দেয়া যায়। তারপর তার কারখানাতেই খুব কম খরচে সাইকেল উৎপাদন শুরু করেন তিনি। কারখানার শ্রমিকরা যেই সাইকেল উৎপাদন করতেন, সোচিরো হোন্ডা সেই সাইকেলের সাথেই মোটর জুড়ে দিয়ে তৈরি করে ফেলেন মোটরবাইক। বাজারে ছাড়ার সাথে সাথেই তার মোটরবাইক বা মোটরসাইকেল, যাই বলা হোক না কেনো, বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন এবং গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে।
প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি শুধু সাইকেলের ফ্রেমগুলোই কারখানায় উৎপাদন করতেন আর মোটরগুলো তিনি বাইরে থেকে সোর্সিং করতেন। যখন প্রচুর পরিমাণে মোটরবাইক বিক্রয় হতে শুরু করে এবং চাহিদা বেড়ে যায়, তখন উৎপাদন খরচ আরো কমিয়ে আনার উদ্দেশ্যে তার কারখানাতেই মোটর উৎপাদন শুরু করেন। আর এভাবেই শুরু হয় বিখ্যাত হোন্ডা মোটরস করপোরেশনের মোটরবাইকের যাত্রা।
হোন্ডা মোটরসের উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহ
হোন্ডা মোটরস করপোরেশনের প্রায় ৭৬ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। একটি লেখার মাধ্যমে তার সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তাই হোন্ডা মোটরসের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে এবং তা সাল অনুযায়ী ভাগ করে দেয়া হয়েছে।
১৯৪৬ সাল
- কারখানার নেতৃত্ব গ্রহণ করে সোচিরো হোন্ডা, হোন্ডা টেকনিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।
- কারখানায় তিনি “Rotary Weaving Machine”, “Frosted Glass Window” এবং “Woven Bamboo Roof Panel” তৈরি করার চেষ্টা করেন।
- 2-Stroke মোটরগুলোকে মোডিফাই করে টার্পেন্টাইনের সাহায্যের চালানোর ব্যবস্থা করেন এবং সেগুলোকে সাধারণের সাইকেলের সাথে জুড়ে দেন।
- তার তৈরি মোটরবাইক ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
- নিজের কারখানাতেই মোটর উৎপাদন শুরু করেন।
১৯৪৭ সাল
- দেড়-হর্সপাওয়ারের মোটর উৎপাদন করেন এবং তার নাম দেন “The Chimney” (কারণ মোটর থেকে প্রচুর ধোয়া উৎপন্ন হচ্ছিল)।
১৯৪৮ সাল
- লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে হোন্ডা মোটর কোম্পানি কে নিবন্ধন করা হয়।
১৯৪৯ সাল
- প্রথমবারের মতো হোন্ডা অত্যাধুনিক ডি-টাইপ স্টিল ফ্রেইমের মোটরবাইক উৎপাদন করে যার সামনে ও পেছনে সাসপেনশনের ব্যবস্থা ছিল এবং তা প্রতি ঘন্টায় ৫০ মাইল গতিতে ছুটতে পারতো।
১৯৫৯ সাল
- ১১ জুন প্রথমবারের মতো হোন্ডা মোটরস করপোরেশন দেশের বাইরে তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠা করে এবং লস এঞ্জেলসে ৬ জন কর্মী নিয়ে তাদের প্রথম শোরুম স্থাপন করা হয়।
- আমেরিকায় প্রথম হোন্ডা পণ্য হিসেবে বিক্রয় হয় “The Cub”।
১৯৬২ সাল
- হোন্ডা তাদের অ্যাড ক্যাম্পেইন “You meet the nicest people on a Honda” চালু করে।
- আমেরিকায় তাদের পাওয়ার ইক্যুইপমেন্ট বিক্রয় শুরু হয়।
১৯৬৪ সাল
- আমেরিকায় তাদের E-40 এবং E-300 পোর্টেবল জেনারেটর বিক্রয় শুরু হয়।
১৯৬৯ সাল
- হোন্ডা তাদের Honda Dream CB750 Four আমেরিকায় বিক্রয় শুরু করে।
- প্রথম হোন্ডা অটোমোবিল হিসেবে Honda N600 আমেরিকায় বিক্রয় হয়।
১৯৭৩ সাল
- হোন্ডা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কম শব্দের মোটর হিসেবে তাদের 4-Stroke Marine Motor আবিষ্কার করে।
- আমেরিকায় প্রথমবারের মতো ফুয়েল ক্রাইসিস দেখা দিলে হোন্ডা তাদের Civic Hatchback নিয়ে আসে।
- সোচিরো হোন্ডা কোম্পানিথেকে রিসাইন করেন। তবে কোম্পানির সুপ্রিম অ্যাডভাইজর হিসেবে শেষ পর্যন্ত ছিলেন।
১৯৭৫ সাল
- আমেরিকায় রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশ্যে তারা ক্যালিফোর্নিয়ায় হোন্ডা রিসার্চ ক্যালিফোর্নিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭৬ সাল
- হোন্ডা তাদের “Accord Hatchback” বাজারে নিয়ে আসে।
১৯৭৭ সাল
- তাদের “GL1100 Goldwing” মোটরসাইকেল বাজারে আসে।
১৯৭৯ সাল
- প্রথমবারের মতো আমেরিকায় তাদের উৎপাদন শুরু হয়।
১৯৮৯ সাল
- প্রথম আন্তর্জাতিক অটোমোবিল হিসেবে “The Accord” আমেরিকার বেস্ট-সেলিং খেতাব অর্জন করে।
১৯৯১ সাল
- ৫ই আগস্ট সোচিরো হোন্ডা মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৯৪ সাল
- হোন্ডা রেসিং-কার মার্কেটে প্রবেশ করে।
১৯৯৮ সাল
- হোন্ডা তাদের “Civic Natural Gas” বাজারে নিয়ে আসে যা ছিল পুরোপুরি প্রাকৃতিক গ্যাস নির্ভর।
২০০৩ সাল
- হোন্ডা তাদের “Safety For Everyone” ক্যাম্পেইন চালু করে।
২০০৬ সাল
- হোন্ডা এয়ারক্রাফট কোম্পানি যাত্রা শুরু করে।
২০১০ সাল
- হোন্ডা “CR-Z Sport Hybrid” গাড়ির মাধ্যমে হাইব্রিড গাড়ি মার্কেটে প্রবেশ করে।
২০১১ সাল
- আমেরিকান হোন্ডা মোটরস তাদের প্রতিষ্ঠার ৫০ বর্ষপূর্তি উদযাপন করে।
২০১৩ সাল
- তাদের বার্ষিক আয়ের ৫.৭% বা ৬.৮ বিলিয়ন ডলার রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টে বিনিয়োগ করা হয়।
উল্লেখিত ঘটনাবলি ছাড়াও হোন্ডার ইতিহাসে আরো অনেক বিষয়াদি রয়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করেছি শুধু এমন বিষয়গুলো তুলে ধরতে যার মাধ্যমে হোন্ডা বার বার বিশ্ব মোটর সেক্টরে নতুন নতুন স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছে এবং যেসব অর্জন তাদের নিজেদের জন্যেও ছিল অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠাকালীন সোচিরো হোন্ডা একটি আন্তর্জাতিক মানের মোটর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বলা যায় তার স্বপ্ন বাস্তবে রুপান্তরিত হয়েছে হোন্ডা মোটরস করপোরেশনের মাধ্যমেই।
শখের গাড়ির সকল তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে এবং গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী ব্যবহার করতে পারেন। এটি একটি ভেহিক্যাল ট্র্যাকার সার্ভিস (VTS) ডিভাইস যা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে পাই ল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রহরী – ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং সিস্টেমে রয়েছে অ্যাপের মাধ্যমে ইঞ্জিন লক/আনলক করার সুবিধা, গাড়ির লাইভ ট্র্যাকিং আপডেট দেখা, এবং ট্রাভেল হিস্টোরি চেক করা সহ আরও অনেক সুবিধা বিস্তারিত জানতে দেখুন প্রহরী প্যাকেজ সমূহ।