প্রতিদিন রাস্তাঘাটে বের হয়ে, গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করার পরেও যে জীবন নিয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসতে পারছেন তার জন্য আপনি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিতেই পারেন। এর পাশাপাশি আপনার উচিৎ আরও এক ব্যাক্তিকে ধন্যবাদ দেয়া, যার জন্য আপনি হয়ত বহু দুর্ঘটনা এড়িয়ে এখনও নিঃশ্বাস নিয়ে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন।
তার আগে চিন্তা করুন তো, রাস্তার মাঝে সাদা দাগ দিয়ে আঁকা কোন ট্রাফিক লেন ডিভাইডার নেই। আপনি যখন এমন একটি রাস্তায় গাড়ি চড়ে এক জায়গা থেকে আরক জায়গায় যাচ্ছেন, অপরদিক থেকে একটা বড় মালবাহী ট্রাক তো আপনাকে চাপা দিয়ে চলে যেতে পারতো, তাইনা? কিন্তু এখন কেন চাপা দিতে পারছেনা জানেন? কারণ রাস্তার লেন নির্ধারিত এবং লেন মেনে গাড়ি চলে বিধায় আজ দুর্ঘটনার পরিমাণ এত কম। কিন্তু এক সময় যখন রাস্তার ট্রাফিক লেন নির্ধারিত ছিল না তখন সড়ক দুর্ঘটনার হার আরো অনেক বেশি ছিল।
সুতরাং যে ব্যাক্তি রাস্তার মাঝে এই লেন ডিভাইডার আঁকার কথা প্রথম ভেবেছিলেন তাকে তো ধন্যবাদ দেয়াই যায়। কারণ তার এই আইডিয়ার কারণেই হয় আজ দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাতায়াত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন কে এই ব্যাক্তি? কে প্রথম রাস্তার মাঝে সাদা দাগের মাধ্যমে ডিভাইডার ট্রাফিক লেন এঁকেছিলেন?
ট্রাফিক লেন এর আইডিয়া কার?
সবার প্রথমে রাস্তার লেন আঁকার ধারণা দিয়েছিলেন একজন মহিলা। যার নাম জুন ম্যাকক্যারল। রাস্তার মাঝ বরাবর সাদা দাগ দিয়ে লেন চিহ্নিত করার ধারণ দেয়ার জন্য, আসুন প্রথমে তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। এরপর চলুন জেনে নেয়া যাক তার গল্প- কীভাবে তিনি লেন আঁকার গুরুত্ব অনুধাবন করলেন আর কীভাবে তার ধারণার বাস্তব রূপ পেল!
রাস্তার মাঝ বরাবর দাগ টেনে ট্রাফিক লেন পৃথক করে গাড়ি চালানোর ধারণা খুব সাধারণ একটি ধারণা মনে হলেও, এক সময় রাস্তার মাঝে লেন তৈরি করার কথা চিন্তা করাও বেশ দুরূহ কাজ ছিল। অথচ দেখুন, আজ আমরা লেন ছাড়া একটা রাস্তার কথা কল্পনাও করতে পারি না। তবে এটাও সত্য যে, পূর্বে রাস্তার মাঝে কোন ডিভাইডার লেন ছিল না। সেসময় ঘোড়ায় টানা গাড়ি এক পাশ থেকে ছুটে আরেক পাশে চলে আসলে, আর তার সামনের কোন যানবাহন থাকলে পুরো রাস্তার অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে উঠতো।
জুন ম্যাকক্যারল নিজেই তার সময়কার রাস্তাঘাটের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন,
আমি একদিন আমার মডেল টি ফোর্ড গাড়িটি নিয়ে মহাসড়কের পাড় ধরে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। হঠাত দেখলাম একটি ট্রাক মোটামুটি গতিতে আমার গাড়ির সামনে চলে এলো। আমি হঠাত করেই হতবিহবল হয়ে পড়েছিলাম এবং ভাগ্য ভাল যে খুব দ্রুতই আমি ট্রাকটিকে পাশ কাটিয়ে রাস্তার ধারের বালুর বেষ্টনীতে গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলাম।
ম্যাক ক্যারল ছিলেন একজন নার্স। পরবর্তীতে তিনি ডাক্তার হয়েছিলেন। রাস্তায় তার এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর তিনি যখন প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরে এলেন। তিনি ভাবলেন কিছু একটা করা দরকার। সাউদার্ন প্যাসিফিক রেইল রোডের হয়ে তিনি রাস্তার মাঝবরাবর সাদা দাগ টেনে লেন তৈরি করার আইডিয়া চেম্বার অফ কমার্স এবং রিভারসাইড কান্ট্রি বোর্ডের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তার এই প্রস্তাব অনেকটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন তখনকার কর্তা ব্যক্তিরা। তিনি বুঝেছিলেন তৎকালীন সময়ে নারী হিসেবে তার বুদ্ধির সমাদর হবে না। কারণ সেই সময়ে পশ্চিমা বিশ্বেও নারী বৈষম্য ছিল চরমে।
কীভাবে ট্রাফিক লেন আঁকা হল?
যেহেতু তার প্রস্তাব কেউ আমলেই নিলো না, তাই তিনি সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মানবতার সেবায় নিজেই পথে নেমে গেলেন। নিজেই রঙ আর ব্রাশ নিয়ে রাস্তার মাঝে লেন আঁকার কাজ করতে নেমে গেলেন। তিনি মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধিটুকু জন্ম দিতে চেয়েছিলেন যে, মানুষ যেন বুঝতে পারে তার এই লেন তৈরির ধারণাটি আসলেই একটি ভাল ধারণা এবং এর ফলে পথে ঘাটে এক্সিডেন্ট করে মানুষের মরে যাওয়ার হার কমে আসবে। তার এই ব্যাক্তি উৎসাহে এবং স্ব-উদ্যোগে ট্রাফিক লেন আঁকার কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রতিটি লেনের প্রসস্থতাও নির্ধারণ করেছিলেন। তার এই অক্লান্ত পরিশ্রম এবং বারং বার সরকারের কাছে চিঠি লেখার ফলে ক্যালিফোর্নিয়ার রাস্তায় দাগ দিয়ে লেন আঁকা এবং লেন মেনে গাড়ি চালানো আইনের আওতায় এলো ১৯৪০ সালে। এরপর সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করেছিল।
যদিও রাস্তার মাঝ বরাবর সাদা লেন আঁকার আইডিয়া নিয়ে বিরোধ আছে। ওয়েইন কান্ট্রি রোড কমিশনের একজন সদস্য এডওয়ার্ড এন হেইন্স দাবি করেন, তিনিই সবার আগে ১৯১১ সালে রাস্তার ট্রাফিক লেন বিভক্ত করার আইডিয়া দিয়েছিলেন। তার এই দাবি সত্য কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানান জনের নানান মত।
কিন্তু ম্যাকক্যারল ট্রাফিক লেন বিভক্ত করার পেছনে যে শ্রম এবং একাগ্রতা দেখিয়েছেন তা কিন্তু মানব ইতিহাসে বিরল। নিজের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়ে তিনি বাঁচাতে চেয়েছেন হাজারও মানুষের জীবন। তিনি তাই আমাদের পক্ষ থেকে সামান্য ধন্যবাদ পাবার দাবিদার হতেই পারেন। রাস্তায় এক্সিডেন্ট থেকে নাহয় বাঁচা গেল, কিন্তু গাড়ির সুরক্ষা আর নিরাপত্তা কে দিবে? সেই কাজটিও করছে প্রহরী ভেইকেল ট্র্যাকার।