গাড়িতে তেল খরচ বেশি হওয়ার কারণ কি? বিষয়টি দুশ্চিন্তার কারন গাড়ির মালিকদের কাছে। যানবাহনে ব্যবহার হওয়া জ্বালানির মধ্যে তেল ছাড়াও রয়েছে গ্যাস, এলপিজি ইত্যাদি। কিন্তু অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহার হলেও একটা গাড়িতে তেলের ভূমিকা অবিচ্ছেদ্য। গাড়ির ইঞ্জিনকে পর্যাপ্তভাবে লুব্রিকেট করা থেকে শুরু করে ক্ষতিকর ঘর্ষণ প্রতিরোধ করা, তেল ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। অতি প্রয়োজনীয় এই জ্বালানির দামের ঊর্ধ্বগতি এবং আরও বিভিন্ন কারনে গাড়ির তেল খরচ আজ যেন লাগামহীন।
নিত্যদিনের যাতায়াতের খরচ কমাতে অনেকেই কিনে নেন ব্যাক্তিগত ব্যবহারের একটি গাড়ি কিংবা বাইক। এই ব্যক্তিগত বাহনই যখন স্বাভাবিকের চাইতে অনেকটা বেশি জ্বালানি তেল খাওয়া শুরু করে, তখন শখের সেই বাইক বা গাড়িটাই যেন হয়ে উঠে গলার কাঁটা। আপনার গাড়িটিতে যেন অস্বাভাবিক পরিমাণে বেশি তেল খরচ না হয় সেই জন্য প্রয়োজন সঠিক নজরদারি। আর তার জন্য প্রথমেই জানা প্রয়োজন গাড়িতে বেশি তেল খরচের পেছনের কারণ, পূর্বলক্ষণ ইত্যাদি। আজকের ব্লগটিতে আলোচনা হবে এসব খুটিনাটি নিয়েই।
গাড়িতে তেল খরচ বেশি হওয়ার কারণ কি?
গাড়িতে তেল খরচ বেশি হওয়ার কারণ গুলো নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আমাদের গাড়ি চালানোর খরচ এবং পরিবেশের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন কারণের মধ্যে আছে ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা, গতি ও ড্রাইভিং স্টাইল, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, রাস্তাঘাটের অবস্থা, এবং আরো অনেক কিছু। গাড়িতে বেশি তেল খরচের লক্ষ্মণ গুলো জেনে নেয়ার পরে এখন জেনে নিতে পারি এই তেল খরচের সাধারণ কারনগুলা।
১. ইঞ্জিনের তেলের মান
একটি গাড়িতে কেমন তেল ব্যবহার করতে হবে সেটা সেই গাড়ির ম্যানুয়ালে থাকা স্পেসিফিকেশন ও চাহিদা মেনে ব্যবহার করা উচিত। গাড়িতে বেশি তেল খরচের অন্যতম একটি কারন হচ্ছে সঠিক ধরনের তেল ব্যবহার না করা। এমনকি কমদামী নিম্নমানের তেল ব্যবহার করলেও তেল বেশি খরচ হয়। কারন ওই নিম্নমানের তেল গাড়ির ইঞ্জিনের পার্টসগুলোকে ভালোভাবে লুব্রিকেটেদ রাখতে পারে না। যার কারণে ইঞ্জিন আরো বেশি তেল খাওয়া শুরু করে।
২. সঠিক সময়ে তেল পরিবর্তন না করা
আমরা অনেকেই জানি যে, যে কোন গাড়িরই ইঞ্জিনের তেল একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর পরিবর্তন করতে হয়। এবং এটা খুবই জরুরি। এই তেল যদি সময়মতো পরিবর্তন করা না হয় তাহলে সেই পুরনো তেলের মান দিন দিন কমতে থাকে। সময়ের সাথে সেই পুরনো তেলে দূষিত পদার্থ ও ময়লাও জমতে থাকে। ফলাফল স্বরুপ নিম্নমানের তেলে ইঞ্জিনে তেল খরচও হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি।
৩. পুরনো পিস্টন রিং
পিস্টন ও সিলিন্ডারের দেয়ালের মধ্যে ফাকা স্থান বন্ধ করে শক্ত বন্ধন তৈরি করে বলে এটি গাড়ির খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্টস। এইগুরুত্বপূর্ণ পিস্টন রিংগুলো যখন খুব বেশি পুরনো হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় বা জং ধরে যায়, তখন ইঞ্জিনের তেল সেই রিং ভেদ করে অভ্যন্তরীণ দহন চেম্বারে প্রবেশ করে ফেলে। যার ফলে বেশি বেশি তেল পোড়ে ও পিস্টনে কার্বন জমা হয়।
৪. ক্ষতিগ্রস্থ ইঞ্জিন সিল ও গ্যাসকেট
গাড়ির ইঞ্জিন সিল বা গ্যাসকেট, এবং ইঞ্জিনের তেল খুব পুরনো বা নিম্নমানের হলে ইঞ্জিনের উচ্চ তাপমাত্রা ও গরম তেলের সংস্পর্শে সেটা ক্ষতিগ্রস্থ বা ছিড়ে যেতে পারে। যার ফলাফল স্বরুপ হতে পারে তেলের লিকেজ। এর থেকেই তৈরি হতে পারে অতিরিক্ত গাড়ির তেল খরচের সমস্যা। নিয়ম মতো নির্দিষ্ট সময় পর পর ইঞ্জিনের তেল পরিবর্তনের মাধ্যমে গাড়ির ইঞ্জিন সিল ও গ্যাসকেটকে তাড়াতাড়ি নষ্ট হওয়া থেকে বিরত করা যেতে পারে।
৫. পুরনো জীর্ণ ইঞ্জিন
ইঞ্জিন খুব বেশি পুরনো হয়ে গেলে গাড়ির তেল খরচ জনিত সমস্যা বেশি বেশি দেখা দেয়। কারন ইঞ্জিন বেশি পুরনো হয়ে গেলে তার নানান যন্ত্রাংশতেও ক্ষয় দেখা দেয়। আর সেই ক্ষয়প্রাপ্ত যন্ত্রাংশ দিয়ে গাড়ির তেল লিক হওয়ার প্রবনতা অনেক বেশি।
গাড়ির তেল খরচ বেশি হলে বুঝবেন কিভাবে?
নতুন গাড়ি কিনলেই কিংবা গাড়ির খরচ বাড়লে আমরা সবাই চিন্তিত হই। কিন্তু কীভাবে বুঝবেন আপনার গাড়ির তেল বেশি খরচ হচ্ছে কি না? তেল খরচের মাত্রা যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আপনার গাড়ির কার্যকারিতা এবং আপনার পকেটের ওপর প্রভাব ফেলে। আপনার গাড়িতে তেল খরচ হওয়ার পরিমাণ কি স্বাভাবিক, নাকি বেশি? এটা যদি আপনি নিজে থেকে বুঝতে না পারেন, তাহলে খেয়াল করুন এই বিষয়গুলো-
১. ধোঁয়ার রং
গাড়ির তেল খরচ বেশি হওয়ার একটি অন্যতম লক্ষ্মণ হচ্ছে নীল বা ধুসর ধোয়া। এর অর্থ হচ্ছে ইঞ্জিনের তেল কমবাশ্চন (Combustion) বা দহন চেম্বারে প্রবেশ করেছে এবং জ্বলছে। পিস্টন রিংয়ে কোন লিক বা সিলিন্ডারেএ দেয়ালের কোন ক্ষত থেকে এমনটা হতে পারে।
২. লো ইঞ্জিন কম্প্রেশন
গাড়িতে বেশি তেল খরচের সাথে সম্পর্ক রয়েছে লো ইঞ্জিন কম্প্রেশন বা লো সিলিন্ডার কম্প্রেশনেরও। ইঞ্জিন যখন পর্যন্ত বাতাস কম্প্রেস করতে ব্যার্থ হয়, তখন গাড়িতে বেশি তেল খরচ সহ নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। কারো গাড়িতে আসলেই লো ইঞ্জিন কম্প্রেশনের সমস্যা আছে কি না নির্ণয় করার জন্য গাড়ির ভালভ, সিলিন্ডার, পিস্টন রিং ইত্যাদির সাহায্যে কম্প্রেশন টেস্ট করা যেতে পারে।
৩. পোড়া তেলের গন্ধ
গাড়িতে পোড়া তেলের গন্ধ পাওয়া গেলে ধরেই নিতে পারেন, অতিরিক্ত অনেকটা তেলই অপচয় হয়ে যাচ্ছে আপনার প্রিয় গাড়ির। আর এই বেশি তেল খরচ ও তেল পোড়ার পেছনের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে থাকে তেলের লিকেজ। চলন্ত গাড়িতে তেল লিক হয়ে গাড়ির গরম ইঞ্জিনে গড়িয়ে পড়ে এবং পুড়ে যায়। ফলাফল, তেল পোড়া বাজে গন্ধ। তাই কারো গাড়িতে তেল পোড়া গন্ধ পাওয়া গেলে অবশ্যই অবহেলা করা যাবে না।
৪. চেক ইঞ্জিন লাইট
চেক ইঞ্জিন লাইটের জ্বলে থাকার সাথেও থাকতে পারে বেশি তেল খরচ বিষয়ক সমস্যার সম্পর্ক। গাড়ির ইঞ্জিন জুড়ে পোড়া দূষিত তেল ছড়িয়ে পড়লে কিংবা তারাতাড়ি তেল শেষ হয়ে অপর্যাপ্ত তেলের কারনে ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা কমে গেলেও এই লাইট জ্বলে থাকতে পারে। তাই চেক ইঞ্জিন লাইট জ্বলে থাকাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে দ্রুত এর পেছনের সমস্যা নির্ণয় ও সমাধান করতে হবে।
৫. ইঞ্জিনে কার্বনের অস্তিত্ব
গাড়ির তেল খরচ বেশি হওয়ার আরেকটি লক্ষন হচ্ছে ইঞ্জিনে উচ্চ মাত্রায় কার্বন জমা হওয়াও। গাড়ির ইঞ্জিনে ব্যবহার হওয়ার জন্য ভরা তেল যখন গাড়ির সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে ঠিকভাবে প্রবাহিত হওয়ার বদলে দ্রুত পুড়ে যেতে থাকে, তখন জমতে থাকে এই কার্বন। পোড়া তেলের অবশিষ্টাংশ স্পার্ক প্লাগ বা ইঞ্জিনের ভালভের নিচেও জমা হতে থাকে।
গাড়ির তেল খরচ বেশি হলে যেসব সমস্যা হতে পারে
- তেল বেশি খরচ হতে থাকলে ইঞ্জিনে তেলের লেভেল কমে যায়। তখন পর্যাপ্ত লুব্রিকেশন না তৈলাক্ততার অভাবে ইঞ্জিনের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
- গাড়ি যতটুকু চলেছে তার চেয়েও বেশি তেল খরচ হওয়া মানে গাড়িতে তেল ভরার খরচও অপ্রয়োজনীয় রকমের বেশি হওয়া। এই বাড়তি ব্যায় গাড়ির মালিককে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- অপর্যাপ্ত তেল ও তেল লিকেজের কারনে গাড়ির ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা মেরামত ও প্রতিস্থাপনের জন্যও করতে হয় বাড়তি খরচ।
- গাড়িতে তেল বেশি পুড়লে কার্বনের নির্গমনও বেশি হয়। যা পরিবেশ দূষণে ভূমিকা রাখে।
নিজের একটি ব্যক্তিগত গাড়ি মেইনটেইন করা মানে এমনিতেই নানান খরচ। একইসাথে প্রয়োজন ও শখের গাড়িটিতে যদি দেখা দেয় ব্যবহারের বাইরেও অতিরিক্ত তেল খরচের সমস্যা, তাহলে যোগ হয় বাড়তি বিড়ম্বনা। তাই গাড়িকে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতে ব্যক্তিগত যত্নের পাশাপাশি প্রয়োজন নির্দিষ্ট সময়কাল পর পর নিয়ম মতো সার্ভিসিং। এছাড়া সার্ভিসিংয়ের সময় ছাড়াও কোন সমস্যার লক্ষ্মণ দেখা দিলে প্রয়োজন কোন বিলম্ব ছাড়া দ্রুত সেই সমস্যার সমাধান করা। গাড়ির জ্বালানি খরচ কমানোর সবচেয়ে সহজ ৯ টি উপায় জানতে এই ব্লগটি দেখুন।
শেষ কথা
গাড়ির তেল খরচ কমিয়ে আপনি শুধু অর্থনৈতিক সাশ্রয়ই হবে না, বরং পরিবেশেরও উপকার হবে। তাই, আজ থেকেই আপনার গাড়ির প্রতি একটু বাড়তি যত্ন নিন এবং দেখুন কিভাবে তেল খরচ কমে আসে, ড্রাইভিংহয়ে ওঠে আরও সহজ এবং পরিবেশবান্ধব।