পৃথিবীর নানান বিস্ময় জাগানিয়া জিনিস ও জ্ঞানের ভাণ্ডার নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকে একেকটি জাদুঘরের চার দেয়াল। শিল্পকলা, বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, সংস্কৃতি, ইতিহাস আরো নানান বিষয়ে জ্ঞান পিপাসু মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে বিশ্বের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অগনিত সব জাদুঘর। যেগুলোয় ঢুকলে, এর ভেতরে সাজিয়ে রাখা জিনিসগুলোর প্রতি অবাক বিস্ময়ে মনের অজান্তেই হয়তো থমকে দাড়াতে হবে, কোন কিছু দেখে হয়তো চোখ উঠবে কপালে।
এতোসব জাদুঘরের ভিড়ে আলাদা করে শুধুমাত্র গাড়ির জাদুঘরও যে আছে বিশ্বের কোন কোন যায়গায়, তা জানেন কী? জ্বি, এমনও কিছু জায়গা আছে। যেখানে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে ঐতিহাসিক কিংবা ঘটনাবহুল বিভিন্ন গাড়ি ও বাহনের। আজকে জানবো এই পৃথিবীর আলাদা আলাদা যায়গায় মাথা উঁচু করে থাকা সেইসব গাড়ির জাদুঘর নিয়েই।
১. অটোওয়ার্ল্ড – ব্রাসেলস, বেলজিয়ামঃ
হাজারেরও বেশি গাড়ি সংগ্রহে রাখা এই জাদুঘরটি যেনো গাড়িপ্রেমীদের স্বর্গ। যদিও সাধারণ দর্শনার্থীদের দেখার জন্য প্রদর্শন করা থাকে মাত্র ৩০০ টি গাড়ি। গাড়ি আবিষ্কারের পর থেকে অত্যাধুনিক যুগ পর্যন্ত গাড়ির প্রযুক্তি ও ডিজাইনগত পরিবর্তনের যে যাত্রা, তার সব যেন একসাথে চোখের সামনে রাখা বেলজিয়ামের এই জাদুঘরে।
এই জাদুঘরেই একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে, যেখানে শুধুমাত্র বেলজিয়ামের রাজপরিবারের বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করা গাড়িগুলো প্রদর্শিত আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে গাড়ি প্রদর্শনের ধরন প্রতি বছর বছরই পরিবর্তন হয়, নতুন বছরে প্রদর্শনীতে যোগ হয় নতুন কিছু।
২. সিটাডেল অটোমোবাইল – ফ্রান্সঃ
ফ্রান্সের মালহাউজে অবস্থিত বিশালাকার এই জাদুঘরটি এতোই বড় যে, এর একটি রুমেই রয়েছে ৮০০টি স্ট্রিটলাইট! বিশ্বের ৯৮ টি ব্র্যান্ডের মোট ৫২০ টি গাড়ি প্রদর্শিত আছে এখানে। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেকটি গাড়ি ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরে ঘুরে প্লাটফর্মে প্রদর্শিত হয়। এবং গাড়িগুলির সাথে থাকা স্ক্রিনে ডিসপ্লে হতে থাকে সেই গাড়ির বর্ণনা।
গাড়ির অত্যাধুনিক প্রদর্শনী ছাড়াও এখানকার আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে ‘হল অব ইঞ্জিনস’। যেখানে ১৮৮০ সালে ইঞ্জিন আবিষ্কার থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইঞ্জিনের ইতিহাসের পুরো বৃত্তান্ত দেখা যাবে চোখের সামনে। এখানেই শেষ নয়! সব মানুষের কাছে জাদুঘরের বিভিন্ন বিষয় সহজভাবে বোধগম্য করার জন্য জাদুঘর কর্তৃপক্ষ রেখেছে গাড়ি বিষয়ে এনিমেশনের ব্যবস্থাও।
৩. অডি মিউজিয়াম – ব্যাভারিয়া, জার্মানিঃ
কটি নির্দিষ্ট কোম্পানির বাহনের উপর নির্ভর এই জাদুঘরটি। তাতে কী কোন অংশে আকর্ষণ কম এর? মোটেই না, বরং গাড়িপ্রেমীদের আকর্ষণের ভান্ডার যেন এখানে। এই জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের ভ্রমণ করায় ঐতিহ্যবাহী অডি কোম্পানির পুরো ইতিহাসের দুনিয়ায়। শুধু চোখে দেখে মন জুড়ানোর ব্যবস্থা- এমনটি কিন্তু নয় এই জাদুঘর।
অডির তৈরি বিভিন্ন বাহনের নানান যন্ত্র বা ফিচার হাতে ধরে অভিজ্ঞতা নেয়ার ব্যবস্থাও আছে জাদুঘরের বিভিন্ন দেয়ালজুড়ে। মোটরসাইকেল, সাধারণ গাড়ি, কিংবা রেসিং কার, অডির সব ডিজাইনের দেখাই পাওয়া যাবে এখানে।
৪. দ্যা পিটারসেন মিউজিয়াম – ক্যালিফোর্নিয়াঃ
বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি জাদুঘরগুলির মধ্যে আরেকটি হচ্ছে, আমেরিকান পাবলিশার রবার্ট পিটারসেন ও তাঁর স্ত্রী মার্জি পিটারসেনের প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘরটি। ২৫ টি বিরাট গ্যালারীতে মোট ১৫০ টি গাড়ি প্রদর্শিত হয় এখানে। এটি এমন জাদুঘর যেখানে একজন দর্শনার্থী একই ছাদের নিচে একই সাথে দেখতে পাবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যবাহী গাড়ি, রাজকীয় ডিজাইনের আকাশ ছোঁয়া দামের দামী গাড়ি, সেলেব্রিটিদের ব্যবহৃত গাড়ি, বিখ্যাত কোন রেসিংয়ে ব্যবহার হওয়া রেসিং গাড়ি ইত্যাদি। সুরের জাদুকর এল্ভিস প্রিসলির ব্যবহৃত গাড়ির দেখাও পাওয়া যাবে আমেরিকার এই জাদুঘরে।
কিন্তু শুরুতেই যে বললাম বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি জাদুঘরগুলির মধ্যে একটি! এতো বড় জাদুঘরে কী মোটে ১৫০ টি গাড়ি থাকে? মূল আকর্ষণটা এখানেই, পিটারসেন জাদুঘরের ‘ভোল্ট’। যেখানে আছে বিশ্বের নানা প্রান্তের বিরল ও আকর্ষণীয় আরো ২৫০ টি গাড়ি। ১২০ বছর আগের পুরনো গাড়ি থেকে এযুগের অত্যাধুনিক সুপারকার, গাড়ির ইতিহাসের রাস্তায় ভ্রমণ করাতেই বিশেষভাবে প্রস্তুত এই জাদুঘরের ভোল্টটি। তবে ভোল্টে ঢোকার টিকেট পেতে হলে দর্শনার্থীর বয়স অবশ্যই ১০ বছরের উর্ধ্বে হতে হবে। ছবি না তোলা, কিছু স্পর্শ না করা, দলছুট না হওয়ার মতো নানান নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে জাদুঘরের বিশেষ এই অংশের জন্য।
৫. লোম্যান মিউজিয়াম – নেদারল্যান্ডসঃ
বিশাল এই জাদুঘরটি মূলত একটি পারিবারিক সংগ্রহশালা। ডাচ ব্যাবসায়ি ও শিল্পপতি পরিবার লোম্যান পরিবার। টয়োটা, লেক্সাস, মরগান, সুজুকির মতো বিখ্যাত সব অটোমোবাইল কোম্পানির সাথে তাদের আমদানি রপ্তানির ব্যবসা। বিশের দশকে পুরো ইউরোপে লোম্যান কোম্পানিই ছিলো অটোমোবাইলের সবচেয়ে বড় ডিস্ট্রিবিউটর। বুঝতেই পারছেন, অটোমোবাইল ও গাড়ির সাথে তাদের সম্পর্ক সেই বহু আগের।
ফিরে আসি জাদুঘরের প্রসঙ্গে। লোম্যান মিউজিয়ামটি হচ্ছে লোম্যান পরিবারের দুই প্রজন্ম ধরে সংগ্রহ করা গাড়িরই সংগ্রহশালা ও জাদুঘর। ১৯৩৪ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ব্যাক্তিগত ব্যবহার ও সংগ্রহ করা ২০০ টিরও বেশি গাড়ি আছে বর্তমানে পারিবারিক ঐতিহ্যবাহী এই জাদুঘরে।
৬. ‘আরব কিং অব কার’ এর সংগ্রহশালাঃ
আবুধাবির বাসিন্দা শেখ হামাদ বিন হামদাদ আল নাহিয়ান, যাকে বলা হচ্ছে ‘আরব কিং অব কার’। একসময় মিলিটারিতে কাজ করা ভদ্রলোকের শখ, স্বপ্ন, ভাবনা সবই গাড়িকে ঘিরে। তাই তো গড়ে তুলেছেন নিজেই একটি গাড়ির জাদুঘর। তাঁর জাদুঘরের গাড়িগুলি কোনটাই খুব একটা বিলাসবহুল না হলেও, সাধারণ আর দশটা গাড়ির থেকে আলাদা।
যেসব ডিজাইন সাধারনত দেখা যায় না রাস্তায়। এমন সব অনন্য মডেলের ৩ হাজার গাড়ি দিয়ে সাজিয়েছেন তিনি শখের এই সংগ্রহশালা বা জাদুঘরটি। পিরামিড আকৃতির জাদুঘরটিতে তিন বেডরুম বিশিষ্ট গাড়ি থেকে শুরু করে বিশাল দৈত্যাকার কিংবা ক্ষুদ্রাকৃতির গাড়িও রয়েছে। এই জাদুঘরের সবচেয়ে মজার ও আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এখানকার প্রতিটি গাড়িই সচল। সাথে আছে চাবিও। অর্থাৎ, কোন দর্শনার্থী চাইলে চালিয়েও দেখতে পারবেন জাদুঘরের কোন গাড়ি! ৩ হাজার গাড়ির সাথে এই জাদুঘরে আছে একটি উড়োজাহাজও। তবে সেটি চালিয়ে দেখার নেই কোন উপায়।
৭. বাংলাদেশি গাড়িপ্রেমীর ব্যাক্তিগত জাদুঘরঃ
বিশ্বের নানা প্রান্তের জাদুঘরের গল্প তো বললাম। এবার শুনুন নিজ দেশের একটি অদ্ভুত গাড়ি জাদুঘরের কথা। জাদুঘর না বলে এটিকে ব্যাক্তিগত সংগ্রহশালা বললেই মনে হয় বেশি ঠিক শোনায়। রাজধানী ঢাকার উত্তরখানের মৈনারটেক বাজার থেকে কিছুটা উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলে গাছপালা ঘেরা বিশাল একটি গ্যারেজ চোখে পড়বে। মানে বাইরে থেকে দেখতে গ্যারেজই মনে হবে অনেকের। ভেতরে তো আছে ঐতিহ্যবাহী কালেরর সাক্ষী হয়ে থাকা অনেকগুলো গাড়ির বিরাট এক সংগ্রহশালা।
নিতান্ত শখের বশে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মাহমুদুল ফারুক তৈরি করেছেন এই জাদুঘরটি। যিনি এখন প্রয়াত। এখানকার সবচেয়ে পুরনো গাড়িটি ১৯২৬ সালের। শত বছরের পুরনো শেভ্রোলেট থেকে শুরু করে এখানে আরো রয়েছে তিনজন রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আইয়ুব খান ও জিয়াউর রহমানের ব্যবহার করা গাড়ি, জমিদার পরিবারের ব্যবহার করা গাড়ি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যময় ব্রিটিশ সেনাদের ব্যবহার করা গাড়ি। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনীর ব্যবহার করা গাড়ি, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার হওয়া যুদ্ধের বুলেটের ক্ষত বয়ে বেড়ানো গাড়িও আছে এই জাদুঘরে! আরো আছে মার্সিডিজ বেঞ্জ, জাগুয়ার, টয়োটা, অস্টিনসহ নামীদামী ব্র্যান্ডের পুরনো ডিজাইনের গাড়ি। যেগুলো হয়তো এর আগে দেখেছেন হলিউডের পুরনো দিনের সিনেমাতেই!
১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর ফোর্ড কোম্পানির ১৯২৭-৩১ মডেলের একটি গাড়ি সংগ্রহের মাধ্যমে এই সংগ্রহশালাটির সূচনা করেন জনাব মাহমুদুল ফারুক। অটোমোবাইলপ্রেমী প্রয়াত মাহমুদুল ফারুকের এই যাদুঘরে ঐতিহ্যবাহী এতোসব গাড়ির পাশাপাশি রয়েছে প্রায় ২০ টির মতো মোটরসাইকেল। যার বেশিরভাগই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার হওয়া।
শেষ কথা
গাড়ি নিয়ে মানুষের জানার কিংবা ক্রয় করার আগ্রহের শেষ নেই। নতুন হোক কিংবা পুরাতন গাড়ি প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল বরাবরই। বিভিন্ন গাড়ি নিয়ে তাই বেড়ে উঠেছে গাড়ির সংগ্রহশালা। এসব জাদুঘরে মানুষ গাড়ি সম্পর্কে যেমনি জানতে পারে তেমনি উন্মোচিত হয় পুরোন গাড়ির প্রাচীন সব ইতিহাস।
শখের গাড়ির সকল তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে এবং গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী ব্যবহার করতে পারেন। এটি একটি ভেহিক্যাল ট্র্যাকার সার্ভিস (VTS) ডিভাইস যা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে পাই ল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রহরী – ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং সিস্টেমে রয়েছে অ্যাপের মাধ্যমে ইঞ্জিন লক/আনলক করার সুবিধা, গাড়ির লাইভ ট্র্যাকিং আপডেট দেখা, এবং ট্রাভেল হিস্টোরি চেক করা সহ আরও অনেক সুবিধা বিস্তারিত জানতে দেখুন প্রহরী প্যাকেজ সমূহ।