এ যুগে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না এমন মানুষ পাওয়া শুধু দুষ্করই না, অনেকটা অসম্ভবও বলা যায়। তবে গতানুগতিক মোবাইল ফোন ব্যবহারের সাথে যদি যুক্ত হয় গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার, তখন আর বিষয়টা স্বাভাবিক থাকে না। হয়ে যায় যথেষ্ট ভীতিকর। কারণ সড়কপথে দুর্ঘটনাগুলির পেছনে উল্লেখযোগ্য একটি কারণ এই চালকের আসনে বসে, গাড়ি চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার। এক্ষেত্রে গাড়ি চালকদের জন্য একটি নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন হ্যান্ডস ফ্রি ডিভাইসকে বিবেচনা করা হয়। গাড়ি চালকদের জন্য এমনই একটি আধুনিক হ্যান্ডস ফ্রি ডিভাইস বাজারে এনেছে অ্যাপল। যাকে বলা হচ্ছে অ্যাপল কারপ্লে (Apple CarPlay)। বলাই বাহুল্য, শুধুমাত্র আইফোন ব্যবহারকারীদের টার্গেট করেই বাজারে আনা হয়েছে ডিভাইসটি। এটি অ্যাপলের একটি ইন-হাউজ সফটওয়্যার, যা গাড়ির সিস্টেমের সাথে আইফোনকে পেয়ার বা যুক্ত করে।
অ্যাপল কারপ্লে কী?
অ্যাপল কোম্পানির আইফোন ব্যবহারকারীদের জন্য চালকের আসনে বসে ব্যবহারের একটি নিরাপদ বিকল্প হিসেবে ধরা হচ্ছে অ্যাপল কারপ্লে কে। যার মাধ্যমে একই সাথে রাস্তায় গাড়ি চালানোয় মনোনিবেশ করার পাশাপাশি ব্যবহার করা যাবে আইফোনের বিভিন্ন ফিচারও। গাড়ির গতানুগতিক সফটওয়্যার সিস্টেমকে ওভাররাইড করে এটি। যার কারনে গাড়ির চালকের জন্য এর ব্যবহার সহজবোধ্য হয়। গাড়িতেই আইফোনের জন্য নিজস্ব ইন্টারফেস তৈরির মাধ্যমে স্টিয়ারিংয়ের পেছনে বসে মোবাইল ফোন ব্যবহার যতটা সম্ভব নিরাপদ ও সহজ করার চেষ্টা করেছে অ্যাপল কোম্পানি।
ফোন কল, মেসেজিং, কোন কিছু সার্চ করা, অনলাইন ম্যাপ ব্যবহার ইত্যাদি কাজ টাচস্ক্রীনের সাথে স্টিয়ারিং হুইলের কন্ট্রোল ও ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমেও করা সম্ভব অ্যাপল কারপ্লের সাহায্যে। এমনকি অ্যাপল মিউজিক বা স্পটিফাই এর মতো থার্ড পার্টি অ্যাপও এক্সেস করা যাবে। এতো কাজের কাজি হলেও, ইউটিউব সহ এর মতো যে কোন ভিডিও অ্যাপ কিন্তু এক্সেস করা যাবে না এটি দিয়ে। এমনকি কোন গেমসও না। এই ব্যবস্থা করা হয়েছে গাড়ি চালানো ও অ্যাপল কারপ্লে ব্যবহাররত অবস্থায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য।
নতুন বাজারে আসা ব্র্যান্ড নিউ গাড়িগুলোর মধ্যে এই ফিচারটি এখন বেশ নিয়মিতই পাওয়া যাচ্ছে। তবে পুরনো মডেলের গাড়িতেও ব্যবহার করা যাবে অপশনাল এক্সট্রা, কারপ্লে এডাপ্টার বা আফটার মার্কেট আপডেট করানোর মাধ্যমে।
অ্যাপল কারপ্লে এর সুবিধা কী?
এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে নিজের নিত্য ব্যবহার্য আইফোনকে প্রিয় গাড়ির সাথে খুব সহজেই যুক্ত করে ফেলা। এটা ছাড়াও আছে আরো নানান সুবিধা।
১. ডিজিটাল কার কী (চাবি)
অ্যাপল কারপ্লে এর “ডিজিটাল কার কী” ফিচারের সাহায্যে সহজেই নিজের গাড়ি আনলক ও স্টার্ট করা যায় কোন গতানুগতিক গাড়ির চাবি ছাড়াই। এমনকি আইফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ারও ৫ ঘন্টা পর পর্যন্ত এই ফিচারটি ব্যবহার করা যাবে যদি আইফোন এর মাধ্যমে গাড়ির সাথে যুক্ত থাকে।
২. ম্যাপ ও নেভিগেশন
অ্যাপলের ডিফল্ট অ্যাপ অ্যাপল ম্যাপ বিশদভাবে ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে অ্যাপল কারপ্লে এর সাহায্যে। ব্যবহার করা যাবে গুগল ম্যাপও। কানেক্ট করা আইফোনের ইমেইল, ম্যাসেজ, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি থেকে তথ্য নিয়ে এটি চালকের গন্তব্য সম্পর্কে অনুমান করতে পারে। গাড়ি চালানো অবস্থায় কোন লোকেশনের রাস্তা, ল্যান্ডমার্ক এমনকি উল্লেখযোগ্য গাছপালা বা বিল্ডিং সম্পর্কেও পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য পেতে পারেন এর মাধ্যমে অ্যাপল ম্যাপ ব্যবহার করে। রাস্তার ট্রাফিকের আপডেটেড সর্বশেষ সঠিক তথ্যও জানা যায় এর মাধ্যমে। দেখাতে পারে সেই সময়ে ব্যবহার করার মতো বিকল্প রাস্তা। যার ফলে রাস্তায় সময় বাঁচানো সহজ হয়।
৩. কল এবং ম্যাসেজ
আইফোন ব্যবহারকারীদের কাছে নিশ্চয়ই “সিরি” অচেনা নয়? গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের পেছনে বসে একজন অ্যাপলের ভোক্তা শুধুমাত্র ভয়েস কমান্ড দিয়েই যে কাউকে কল করতে পারবেন, মিসড কল রিটার্ন কিংবা অডিও বার্তাও পাঠাতে পারবেন। ব্যবহার করা যাবে কল এবং মেসেজিং এর জন্য ব্যবহার হওয়া হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মতো থার্ড পার্টি অ্যাপও। শুধু তাই না, অপর পাশ থেকে আসা কল রিসিভ করার পাশাপাশি ফোনে আসা মেসেজ পড়েও শোনাবে। এসবটাই করা যাবে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়ে, সিরি কে কমান্ড দেয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ, একজন অ্যাপল কারপ্লে ব্যবহারকারীকে স্টিয়ারিংয়ের পেছনে বসে কখনোই মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ দিতে হবে না।
৪. মিউজিক
গাড়ি চালানো অবস্থায় অ্যাপল কারপ্লে একজন আইফোন ব্যবহারকারীর বিনোদনের জন্য পার্সোনাল ডিজে তেও রূপান্তরিত হতে পারে। কানেক্টেড আইফোনে যদি অ্যাপল মিউজিক বা স্পটিফাইয়ের মতো অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন নেয়া থাকে, তাহলে সিরি কে ভয়েস কমান্ড করার মাধ্যমে শোনা যাবে পছন্দসই যে কোন গান। অ্যাপল কারপ্লে সাপোর্ট করে এমন মিউজিকের অ্যাপ থেকেও পছন্দসই গান সার্চ করে বাজানো যাবে গাড়িতে গাড়ির বিল্ট-ইন কন্ট্রোলের মাধ্যমে। এমনকি স্ট্রিম করা যাবে অনলাইন যে কোন রেডিও কিংবা আওতায় থাকা ফ্রিকোয়েন্সির যে কোন রেডিও।
৫. সহজবোধ্যতা
একজন আইফোন ব্যবহারকারীর কাছে ব্যবহার করা নতুন কোন অভিজ্ঞতা মনে হবে না। কারণ অবশ্যই এর পরিচিত ইন্টারফেস। পুরোপুরি আইফোনের আদলেই তৈরি করা অ্যাপল কারপ্লে এর ইন্টারফেস দেখতে পাওয়া যায় চালকের সিটের সামনের টাচস্ক্রীনে। ইন্টারনেটের সাথে কানেক্টেড থাকে বলে সব ধরনের তথ্য নিয়মিত আপডেট বা হালনাগাদ হতে থাকে নিজে থেকেই। সব মিলিয়ে এর সুযোগ সুবিধা এতোটাই অত্যাধুনিক যে, ব্যবহারের পর গাড়ির আগের ডিফল্ট সিস্টেমকে পুরনো আমলের প্রযুক্তি মনে হতে পারে।
গাড়িতে অ্যাপল কারপ্লে সংযোগ পদ্ধতি
১. ইউএসবি এর সাহায্যে
- ইউএসবি অথবা ইউএসবি-সি লাইটেনিং কেবলের একপ্রান্ত অ্যাপল ডিভাইসে এবং অন্য প্রান্ত গাড়ির বিল্ট-ইন সকেটে কানেক্ট করতে হবে।
- কোন কোন গাড়িতে ডাটা কানেক্টের জন্য একটি মাত্র সকেট ব্যবহার হয়। ভালো করে চেক করে নিতে হবে যে সঠিক সকেট ব্যবহার করা হচ্ছে কি না।
- সকেটের সাথে সংযুক্ত হয়ে গেলে একটি পপ-আপ মেসেজ গাড়ির টাচস্ক্রীন ও আইফোনের স্ক্রিনে দেখা যাবে। যেখানে জিজ্ঞেস করা হবে, ব্যবহারকারী এই সংযোগটি চান কি না। “ইয়েস” এবং “নো” এর মধ্যে “ইয়েস” এ টাচ করলেই গাড়িতে অ্যাপল কারপ্লে চালু হয়ে যাবে।
২. ওয়্যারলেস সংযোগ
- ওয়্যারলেস বা তারহীন সংযোগের জন্য প্রথমেই দেখতে হবে গাড়িটি ওয়্যারলেস পদ্ধতি সাপোর্ট করে কিন না। ওয়্যারলেস পদ্ধতি সাপোর্ট করলেও, প্রথমবারের মতো গাড়িতে অ্যাপল কারপ্লে এর সংযোগ করার সময় ইউএসবি কেবল ও সকেট ব্যবহার করতে হবে।
- গাড়ি ওয়্যারলেস পদ্ধতি সাপোর্ট করলে প্রথমবারের পর আর কেবল দিয়ে সংযোগ জরুরি না।
- ওয়্যারলেস সংযোগের জন্য প্রথমে আইফোনের ব্লুটুথ অন করতে হবে।
- তারপর গাড়ির মাল্টিমিডিয়া স্ক্রিন থেকে সেটিং এ যেতে হবে। সেখানে ব্লুটুথ অপশনে গিয়ে নতুন ডিভাইন এড করার জন্য সার্চ দিতে হবে।
- নতুন ডিভাইসের লিস্ট থেকে যে আইফোন ব্যবহার হবে সেটা সিলেক্ট করে নিয়ে “পেয়ার” করে নিতে হবে। তারপর গাড়ির স্ক্রিনে অ্যাপল কারপ্লে এর আইকন দেখা যাবে।
- একবার আইফোন গাড়ির সাথে পেয়ার করা হয়ে গেলে বার বার পেয়ার করতে হবে না আর। গাড়ি নিজেই আইফোনটিকে চিনে নিবে এবং স্ক্রিনে পপ-আপ মেসেজ আসবে ডিভাইস কানেক্ট করার জন্য।
অ্যাপল কারপ্লে নাকি অ্যান্ড্রয়েড অটো কোনটা ভালো?
- অ্যাপল কারপ্লে এবং অ্যান্ড্রয়েড অটোর বেসিক ফিচার গুলো ব্যাপকভাবে একই বলা যায়। তবে আইফোন ব্যবহারকারীরা, কিংবা যদি বলি একচেটিয়াভাবে আইফোন ব্যবহার যারা পছন্দ করে, তারা গাড়ির স্ক্রিনেও আইফোনের মতোই সহজ, রুচিশীল ও পরিমার্জিত ইন্টারফেস পছন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক। আর তাদের জন্য অ্যাপল কারপ্লে থেকে ভালো কিছু আর হতে পারে না।
- অ্যাপল কারপ্লে অ্যাপল ম্যাপের সাথে অন্যান্য নেভিগেশন ম্যাপও ব্যবহার করতে পারে। তবে অনেকের কাছে অ্যাপল কারপ্লেতে ম্যাপ ব্যবহার করা কম সুবিধাজনক মনে হয় “এরো কী” এর ব্যবহারের জন্য। অন্যদিকে অ্যান্ড্রয়েড অটোতে যে কোন এন্ড্রয়েড ফোনের মতোই যাত্রা শুরু থেকে গন্তব্য পর্যন্ত পুরো যাত্রাপথ দেখায়।
- অ্যাপল কারপ্লে ভয়েস এসিস্ট্যান্ট হিসেবে “সিরি’ ব্যবহার করে। আর অ্যান্ড্রয়েড অটোতে ব্যবহার হয় “গুগল এসিস্ট্যান্ট”। সাধারণভাবেই গুগল এসিস্ট্যান্ট, অ্যাপল কারপ্লে থেকে তুলনামুলকভাবে বেশি সঠিক ও নির্ভুল হিসেবে বিবেচিত হয়।
- উভয়ই বেশ বিস্তৃত রেঞ্জের থার্ড পার্টি অ্যাপ সাপোর্ট করে। অ্যাপল কারপ্লে ক্রমবর্ধমানভাবে এই রেঞ্জ বাড়িয়েই চলেছে। বিশেষ করে মেসেজিং ও মিউজিকের ক্ষেত্রে। তবে অ্যান্ড্রয়েড অটোর অ্যাপ সাপোর্ট তুলনামূলকভাবে বেশ ভালো।
- অ্যাপল কারপ্লে এবং অ্যান্ড্রয়েড অটো দুইটিতেই রয়েছে ওয়্যারলেস সুবিধা। তবে উভয়ের ক্ষেত্রেই এদের সফটওয়্যার ও অন্যান্য বিষয়ে সার্ভিস কতটা ভালো পাওয়া যাবে সেটা নির্ভর করে গাড়ি ও ফোনের মডেলের উপর।
- ফাংশনালিটির দিক দিয়েও অ্যাপল কারপ্লে এবং অ্যান্ড্রয়েড অটো প্রায় একই বলা যায়। অ্যাপল কারপ্লে তুলনামূলক বেশি সহজ ও গোছানো। অপরদিকে, অ্যান্ড্রয়েড অটো বিভিন্ন থার্ড পার্টি অ্যাপের জন্য অধিকতর উন্মুক্ত। তবে অ্যাপল কারপ্লেও আরো বেশি থার্ড পার্টি অ্যাপ সংযুক্ত করার জন্য কাজ করছে।
- উভয়েরই রয়েছে নিজস্ব কিছু শক্তি ও দুর্বল দিক। তবে দুই প্রযুক্তিতেই আসল তুলনাটা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ব্যাক্তিগত পছন্দ এবং কেমন স্মার্টফোন তিনি ব্যবহার করছেন বা করতে পছন্দ করেন তার উপর। একজন এন্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীর কাছে অ্যান্ড্রয়েড অটো ব্যবহার করাই সহজ মনে হবে। আবার একজন আইফোন ব্যবহারকারী অ্যাপল কারপ্লে এর প্রতি আকর্ষিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
অ্যাপল কারপ্লে সম্বলিত বাজারে আসা প্রথম গাড়িটি ছিলও “ফেরারি এফএফ”। ২০১৪ সালে জেনেভা মোটর শোতে সর্বপ্রথম গাড়িটি জনসমক্ষে আনা হয়। এর পর আরও অনেক গাড়ি তৈরি প্রতিষ্ঠানই ফেরারির পদাঙ্ক অনুসরণ করে গাড়িতে এর অত্যাধুনিক সুবিধা যুক্ত করে। বর্তমানে অনেকগুলো ব্র্যান্ডের গাড়িতেই অ্যান্ড্রয়েড অটোর সাথে অ্যাপল কারপ্লে এর সিস্টেমও রাখা হচ্ছে।
শেষ কথা
আমাদের গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতাকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। এর সাহায্যে আমরা সহজে আমাদের প্রিয় মিউজিক শুনতে পারি, কল করতে পারি, এবং রাস্তার নির্দেশনা পেতে পারি। গাড়ি চালানোর সময় আমাদের নিরাপত্তা ও বিনোদনের জন্য এটি একটি অনন্য উদ্ভাবন। ভবিষ্যতের গাড়ি প্রযুক্তি সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের ব্লগটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের সাথে থাকুন। নিরাপদে গাড়ি চালান, সুস্থ থাকুন।