অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস, খুবই পরিচিত দুটি শব্দ। এই ছোট দুটি শব্দের ভেতরেই রয়েছে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন স্মার্টফোন, ট্যাবলেটসহ অন্যান্য গ্যাজেটের বিস্তৃত রেঞ্জ। অ্যান্ড্রয়েড মূলত গুগল দ্বারা ডেভেলপ করা একটি ওপেন সোর্স প্লাটফর্ম। এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বিভিন্ন ম্যানুফেকচারার বা ব্র্যান্ডগুলো নিজস্ব ডিভাইস তৈরি কিংবা কাস্টোমাইজ করতে পারে। নানান অ্যাপের সুবিশাল রেঞ্জের সংকলন, গুগলের নিয়মিত সার্ভিস ও আপডেট একীভূত হয়ে ডিভাইস নির্ভর প্রযুক্তির জগতে অ্যান্ড্রয়েড বর্তমানে একটি শক্তিশালী নাম হয়ে উঠেছে। গুগল থেকে ডেভেলপ করা এমনই একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ হচ্ছে অ্যান্ড্রয়েড অটো। যার কাজ হচ্ছে আপনার প্রিয় গাড়ি ও হাতের অ্যান্ড্রয়েড সেটটির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা।
অ্যান্ড্রয়েড অটো কী?
সংক্ষেপে যদি বলি, নিজের অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনটির একটি স্মার্ট প্রতিফলন নিজের গাড়ির ড্যাশবোর্ডে দেখতে পাওয়ারই আরেক নাম যেন অ্যান্ড্রয়েড অটো। এবার একটু বিস্তারিত বলা যাক। অ্যান্ড্রয়েড অটো হলো এমন একটি সফটওয়্যার, যা হাতের অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাথে গাড়ির সিস্টেমকে কানেক্ট করার মাধ্যমে সেই স্মার্টফোনের বিভিন্ন ফিচারকে গাড়ি চালানো অবস্থায়ই ব্যবহার করার সুযোগ করে দেয়। অর্থাৎ, ফোন ব্যবহার হবে ঠিকই। কিন্তু সেটা হবে স্মার্টফোনের টাচস্ক্রীনকে নিজের হাতে টাচ করা ছাড়াই। হোক সেটা কাউকে কল, মেসেজ করা কিংবা কল, মেসেজ রিসিভ করা, গান শোনা অথবা অনলাইন ম্যাপে রাস্তার দিকনির্দেশনা পাওয়া। সবটাই করা যাবে স্টিয়ারিংয়ের পেছনে বসে, অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনটা নিজের হাতে না ধরেই। একই ফিচার নিয়ে অ্যাপল কারপ্লে বাজারে এসেছে।
কী কী ফিচার আছে অ্যান্ড্রয়েড অটোতে?
অ্যান্ড্রয়েড অটো ব্যবহার করে খুব সহজে বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি মিডিয়া আরো সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এটিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফিচার রয়েছে যার মাধ্যমে গাড়ি ব্যবহারকারীদের আরও বেশি উপভোগ্য করে তোলে। এটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফিচার হল:
১. নেভিগেশন ও ম্যাপ
গুগল ম্যাপ ও এই ধরনের অন্যান্য অনলাইন নেভিগেশন অ্যাপের সাহায্যে যে কোন গন্তব্যের পুরো যাত্রাপথের দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে গাড়ির ড্যাশবোর্ডেই। রিয়েল টাইম ট্রাফিকের অবস্থার সাথে বিকল্প রাস্তা জানার মাধ্যমে যাত্রাপথে বাচানো যাবে মূল্যবান সময়ও। শুধুমাত্র মাইক্রোফোন বাটনে চেপে মুখে “নেভিগেট টূ” উচ্চারণ করলেই পেতে থাকবেন পুরো যাত্রাপথের দিকনির্দেশনা।
শুধু তাই না। চলতি পথে হঠাত গ্যাস স্টেশন বা খাওয়ার জায়গার দরকার হলে,অ্যান্ড্রয়েড অটোর নেভিগেশন অ্যাপ আপনার বর্তমান স্থানকে টার্গেট করে সবচেয়ে কাছাকাছি গ্যাস স্টেশন বা রেস্টুরেন্টও দেখাবে। হতে পারে আপনি গাড়িতে উঠার আগেই কোন জায়গার ব্যাপারে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে সার্চ করেছিলেন।অ্যান্ড্রয়েড অটো সেই জায়গাটিকে সম্ভাব্য গন্তব্য ধরে আগেই সেখানে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ ও কম সময় নিবে এমন রাস্তাটি বের করে রাখবে আপনি কমান্ড না দিলেও।
২. যোগাযোগ
স্টিয়ারিংয়ের পেছনে বসা অবস্থায় জরুরি কোন কল বা ম্যাসেজ আসলে পড়তে হয় বিপত্তিতে। গাড়ি চালানো অবস্থায় এক হাতে ফোন ধরে কথা বলতে গিয়ে যে কত দূর্ঘটনা ঘটে চলেছে সড়কপথে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। এই বিপত্তি সহজেই দূর করতে পারে অ্যান্ড্রয়েড অটো।
ফোনে আসা সকল মেসেজ পড়ে শোনানো, কল রিসিভ করে স্পিকারে কথা বলার ব্যবস্থা করা সহ, প্রয়োজনে কাউকে কল বা মেসেজ করা যাবে। শুধুমাত্র গুগল এসিস্ট্যান্টের মাধ্যমে একটি ভয়েস কমান্ড করে খুব সহজেই করা যাবে এই সব কিছু। এমনকি একই নিয়মে ব্যবহার করা যাবে কল ও মেসেজিংয়ের জন্য থাকা থার্ড পার্টি অ্যাপগুলোও। হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপে, ভাইবার ইত্যাদির মাধ্যমে ইন্টারনেট কানেকশন ব্যবহার করে কল ও মেসেজ আদান প্রদান করা যাবে সহজেই। এমনকি চলতি পথে কোন জরুরি কোন মিটিংও সেরে নেয়া যাবে, যদি গাড়িতে থাকে অ্যান্ড্রয়েড অটো।
৩. মিউজিক সিস্টেম
দূরের বা কাছের যাত্রাপথে অনেকের একটু গানবাজনা না শুনলে যেন চলেই না। এই বিনোদনের সঙ্গীও হতে পারে অ্যান্ড্রয়েড অটো। স্পটিফাই, ইউটিউব মিউজিক, এমাজন মিউজিকের মতো বিভিন্ন থার্ড পার্টি অ্যাপ থেকে পছন্দসই গান সার্চ করা থেকে শুরু করে কেমন ভলিউমে গান বাজবে, কখন পজ হবে, কখন থামবে, কিংবা কখন পরের কোন গানে যাবে, এই সবই করা যাবে হাতের কোন টাচ ছাড়াই। শুধুমাত্র গুগল এসিস্ট্যান্টে ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে।
তবে অ্যান্ড্রয়েড অটোতে আগে শোনা হয়েছে বা সার্চ করা হয়েছে এমন আর্কাইভের গান ছাড়া একদম নতুন গান স্ক্রল করে সার্চ করতে কিছুটা রেস্ট্রিকশন দেখা যায়। নতুন গান ব্রাউজ করার জন্য স্ক্রল করলে মাত্র ৮ থেকে ১০ টা গানের পরই স্ক্রলিং থামানোর জন্য পপ-আপ মেসেজ সামনে চলে আসে। ব্যবহারকারী চালকের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জন্যই এই নিয়ম, অন্তত এমনটাই দাবি অ্যান্ড্রয়েড অটো কর্তৃপক্ষের।
৪. নিউজ ও অডিওবুক
সবার যে যাত্রাপথে গানই পছন্দ হবে, ব্যাপারটা তো এমন নাও হতে পারে। কারো হয়তো গাড়ি চালাতে চালাতে দেশ বিদেশের প্রতিদিনকার খবর শুনতে ভালো লাগে। অ্যান্ড্রয়েড অটো সেটাও পড়ে শোনাবে। কেউ হয়তো বই পড়তে ভালোবাসেন। অথচ গাড়ি চালানো অবস্থায় তো আর বই পড়া যাবে না। তবে শুনতে তো মানা নেই! অডিও বুক থেকে বই পড়েও শোনাতে পারবে অ্যান্ড্রয়েড অটো। এমনকি চলতি পথে গুগল এসিস্ট্যান্টকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারবেন নির্দিষ্ট কোন স্থান ও সময় হিসেবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসও।
কীভাবে অ্যান্ড্রয়েড অটোকে গাড়ির সাথে সংযোগ দিবেন?
গাড়ির সাথে অ্যান্ড্রয়েড অটোর সংযোগের জন্য খুবই সহজ দুটি পদ্ধতি রয়েছে। তবে দুটি পদ্ধতিতেই সক্রিয় ইন্টারনেটের প্রয়োজন হবে সংযোগকালে। হোক সেটা মোবাইল ডাটা কিংবা ওয়াই-ফাই।
১. ইউএসবি ক্যাবলের সাহায্যে
- আনলক করা অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে ইউএসবি অথবা ইউএসবি-সি ক্যাবলের এক মাথার সংযোগ দিতে হবে।
- ক্যাবলের অন্য মাথা গাড়ির ইউএসবি অথবা ইউএসবি-সি পোর্টে সংযোগ দিতে হবে।
- ইউএসবি ক্যাবলের মাধ্যমে স্মার্টফোন ও গাড়ির সংযোগ হয়ে গেলে, গাড়ির ড্যাশবোর্ড স্ক্রিনে অ্যান্ড্রয়েড অটো কানেকশনের অপশন ও নির্দেশনা আসবে।
২. ওয়্যারলেস পদ্ধতিতে
- ওয়্যারলেস পদ্ধতিতে সংযোগের জন্য স্মার্টফোনে ইন্টারনেটের সাথে ব্লুটুথও অন রাখতে হবে।
- মোবাইলের ব্লুটুথ অপশনে গিয়ে সার্চ ডিভাইসের মাধ্যমে ফোন ও গাড়ির সিস্টেমকে “পেয়ার” করতে হবে।
- একবার পেয়ার হয়ে গেলের পরেরবার থেকে ফোনের ব্লুটুথের “ফাউন্ড ডিভাইস” থেকে গাড়ি সার্চ করে বের করে কানেক্ট করতে হবে।
যে কোন পদ্ধতিতেই গাড়ির সাথে অ্যান্ড্রয়েড অটোর প্রথমবারের মতো সংযোগের সময় ৪ ডিজিটের কোড মেলানো লাগতে পারে। গাড়ি ও মোবাইল উভয়ের স্ক্রিনে একই সাথে ৪ ডিজিটের কোড মেলানোর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে সঠিক ফোনটির সাথে সঠিক গাড়ির কানেকশন হচ্ছে কি না।
হাতের স্মার্টফোনটি অ্যান্ড্রয়েড অটো ব্যবহারের উপযুক্ত কি না কীভাবে বুঝবেন?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যান্ড্রয়েড ৬.০ অথবা এর পরের আপডেটের সকল ভার্শনের অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন অ্যান্ড্রয়েড অটো চালানোর জন্য উপযুক্ত। তবে অ্যান্ড্রয়েড ৯ অথবা তার আগের ভার্শনের অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন দিয়ে গাড়িতে অ্যান্ড্রয়েড অটো চালাতে সেই ফোনে অ্যান্ড্রয়েড অটো অ্যাপ ইন্সটল করে নিতে হবে। আর এই অ্যাপটি সম্পূর্ণ ফ্রি-তে পাওয়া যাবে গুগল প্লে স্টোরেই।
স্মার্টফোনটি আগে থেকে কিংবা অ্যাপ ইন্সটল করার পরেও অ্যান্ড্রয়েড অটো চালানোর সময় গাড়ির স্ক্রিনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না এমন পরিস্থিতিও হতে পারে। এক্ষেত্রে গাড়ির সফটওয়্যার আপডেট করে নিতে হবে।
অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ও অ্যান্ড্রয়েড অটোর মধ্যে পার্থক্য কী?
- অ্যান্ড্রয়েডস্মার্টফোন ও অ্যান্ড্রয়েডঅটো এর মধ্যকার সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, স্মার্টফোন হাতের মুঠোয় রেখে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা। আর অ্যান্ড্রয়েডঅটো তৈরি করা গাড়ির ড্যাশবোর্ডের সিস্টেমে ব্যবহার করার জন্য।
- চলন্ত গাড়িতে হাতে স্টিয়ারিং ধরা অবস্থায় মোবাইল ফোন চালানোর চাইলে প্রায় একই ধরনের ফিচার গাড়ির ড্যাশবোর্ডে ব্যবহার করা নি:সন্দেহে সহজ ও নিরাপদ।
- ফোন ব্যবহার করার সময় হাতের ও চোখের নির্দিষ্ট পরিমানে ব্যবহার প্রয়োজন হয়ই। গাড়িতে অ্যান্ড্রয়েডঅটো থাকলে সেই প্রয়োজন আর হয় না। যে কোন কাজে গুগল এসিস্ট্যান্টকে ভয়েস কমান্ড দিলেই হয়ে যায়। যার কারনে মোবাইল ব্যবহারজনিত দূর্ঘটনার আশংকা কমে।
অ্যান্ড্রয়েড অটো কতটা ব্যয়বহুল?
২০১৫ সালের মার্চ মাসে জনসমক্ষে আসাঅ্যান্ড্রয়েড অটো বর্তমানে বাজারে থাকা বেশিরভাগ গাড়িতেই বিল্ট-ইন স্ট্যান্ডার্ড ফিচার হিসেবে থাকছে। যার মধ্যে রয়েছে শেভলোরেট, হোন্ডা, পোলেস্টার, রেনোল্ড এবং ভলভোর মতো নামি-দামি ব্র্যান্ডও। কিছু কিছু পুরনো মডেলের গাড়িতে আলাদা করে অ্যান্ড্রয়েড অটো সেটাপ করার জন্য খরচ করা না লাগলে তাই অ্যান্ড্রয়েড অটো ব্যবহারে আলাদা কোন খরচ নেই বলাই চলে। তবে যেহেতু গাড়িতে অ্যান্ড্রয়েড অটো চালাতে ইন্টারনেট সংযোগের প্রয়োজন। তাই সেই ইন্টারনেটের খরচটা ব্যবহারকারীকেই করতে হবে। গতানুগতিক ব্যবহার্য বিভিন্ন অ্যাপও গুগল প্লে স্টোর থেকে ফ্রি-তেই ইন্সটল করা যায়। অর্থ খরচ করে সাবস্ক্রিপশন নিয়ে ব্যবহার করতে হয় এমন কোন অ্যাপ ব্যবহার করলেও ব্যবহারকারীকে সেই সাবস্ক্রিপশন ফি বহন করতে হবে।
অ্যান্ড্রয়েড অটোর একটি বড় সুবিধাজনক দিক হচ্ছে এর নিয়মিত ফ্রি আপডেট ও সহজবোধ্য ইন্টারফেস। ব্যবহারকারীদের মধ্যকার জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখে, বর্তমানে ছোট বড় প্রায় বেশিরভাগ গাড়ির ম্যানুফেকচারার গাড়ির সিস্টেমে অ্যান্ড্রয়েড অটো ব্যবহারের সুবিধা রাখছে। তবুও, গাড়ি কেনার আগেই অ্যান্ড্রয়েডঅটো ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাইলে, সেই গাড়ির ব্রোশার ও সামগ্রিক খুটিনাটি নিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করে নেয়া যেতেই পারে। এছাড়া একদম পুরোনো মডেলের গাড়িতেও চাইলে ব্যবহার করা যাবে অ্যান্ড্রয়েড অটো। কিছু বাড়তি অর্থ খরচ করে ড্যাশবোর্ডে টাচস্ক্রীনসহ আরো কিছু আফটার মার্কেট মডিফিকেশন করে নিলেই, অ্যান্ড্রয়েড অটোর জন্য একদম উপযুক্ত করে নেয়া যাবে নিজের গাড়িটি।