পরিবেশবান্ধব গাড়ি- শুনতেই কেমন লাগে না? যানবাহন মানেই যেন নানাভাবে পরিবেশের দূষণ। অন্তত এমনটাই আমরা জেনে এসেছি এতোদিন। এই জানায় কিছুটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলো এলন মাস্কের টেসলা, নিজেরদের গাড়িকে পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব গাড়ি দাবি করে। এই দাবীকেও টক্কর দিতে এবার হাজির হয়ে গেছে টয়োটা। উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে শক্তি বানিয়ে টয়োটা এবার বাজারে এমন এক ইঞ্জিন নিয়ে আসছে, যা চলে পানিতে! আর পানির চেয়ে পরিবেশবান্ধব অন্য কিই বা আছে? এই অদ্ভুত প্রযুক্তিতে গাড়ি চলে মূলত “হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল” এর মাধ্যমে। ইতিহাস পালটে দেয়ার মতোই এই অদ্ভুত উদ্ভাবন- টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিন সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
ওয়াটার ইঞ্জিন কি?
ওয়াটার ইঞ্জিন হচ্ছে গাড়ির ইঞ্জিনে ফুয়েল বা তেল জাতীয় জ্বালানি ব্যবহার না করে, সরাসরি পানি ব্যবহার করা। কিন্তু পানি থেকে সরাসরি গাড়ি চলাচলের কাজ করে না। প্রথমে পানি থেকে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়ে সেই হাইড্রোজেন থেকে শক্তি নিয়ে গাড়ি চলবে। হাইড্রোজেনের জন্য ব্যবহার হয় হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল টেকনোলোজি।
টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে?
ওয়াটার ইঞ্জিন নিয়ে মানুষের জানার আগ্রহের শেষ নেই। ওয়াটার ইঞ্জিন কাজের পেছনে বেশ কিছু বিষয় সবার আগে চোখে আসে। যেমন- হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের ব্যবহার, ইন্টার্নাল অক্সিজেন সোর্স সাপ্লাই, বাই পাস প্রোডাক্ট সিস্টেম, রিফুয়েলিং সিস্টেম ইত্যাদি। আসুন জেনে নেই এইসব বিষয়ে বিস্তারিত-
হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল টেকনোলজি
টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিনের মূল বিশেষত্বই হচ্ছে যে, এটি হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ব্যবহার করে কাজ করে। এই বিশেষ সেল মূলত হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনকে একত্রিত করে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর এই সেলের সিস্টেমের “কোর” বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো “ফুয়েল সেল স্ট্যাক”। এখানে একটি ইনটেক গ্রিলের মাধ্যমে পরিমাণ মতো বাতাস সিস্টেমে প্রবেশ করে।
তারপর ফুয়েল সেল স্ট্যাকে বাতাস ও ফুয়েল ট্যাংকে থাকা হাইড্রোজেন একসাথে মিলিত হয়। সেখানেই বাতাসের অক্সিজেন ও ট্যাংকের হাইড্রোজেনের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। যা মূলত শক্তি দেয় টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিনকে। যে কোন প্রক্রিয়া বা বিক্রিয়ারই তো একটি বাই প্রোডাক্ট থাকে। অন্যান্য সাধারণ যানবাহনের ইঞ্জিন যেখানে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে ক্ষতিকর গ্যাস বা ধোয়া নির্গত করে। সেখানে টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিনের বিক্রিয়ার বাই প্রোডাক্ট হচ্ছে পানি। যা জলীয় বাষ্প হিসেবে বাইরে নির্গত হয়।
রিফুয়েলিং বা জ্বালানী ব্যবস্থা
টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিনের প্রাথমিক জ্বালানী উৎস হচ্ছে হাইড্রোজেন। কিন্তু অন্যান্য হাইড্রোজেন নির্ভর গাড়ির ইঞ্জিনের মতো টয়োটার ওয়াটার ট্যাঙ্ক জ্বালানীর জন্য বাহ্যিক স্টোরেজ ট্যাঙ্কের উপর নির্ভর করে না। বরং এই বিশেষ ইঞ্জিন ইলেক্ট্রোড দিয়ে সজ্জিত পানির ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে। সেই ট্যাঙ্ক গাড়ির মধ্যেই ইলেক্ট্রোলাইসিস প্রক্রিয়া চালাতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় পানির অনুগুলি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে বিভক্ত হয়। ইলেক্ট্রোলাইসিস প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন এই হাইড্রোজেনই ফুয়েল সেলে ইঞ্জিনের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার হয়।
নবায়নযোগ্য জ্বালানী উৎপাদন চক্র
প্রথাগত ইঞ্জিনকে আরেকটি বিষয়ে টেক্কা দিতে প্রস্তুত টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিন। আর সেটা হচ্ছে ইঞ্জিনের জ্বালানির নবায়নযোগ্যতার ব্যাপারে। টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিনের হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে হচ্ছে হাইড্রোজেন। এর ইলেক্ট্রোড সজ্জিত পানির ট্যাঙ্কে থাকা পানি ক্রমাগত থেকে হাইড্রোজেন তৈরি করতে থাকে। আর সেই হাইড্রোজেন আবার হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলে বাতাসের সাথে বিক্রিয়া করে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে পানি তৈরি করে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত ট্যাঙ্কে পানির উপস্থিতি থাকে ততক্ষন এই ওয়াটার ইঞ্জিন বাইরের হাইড্রোজেনের উপর নির্ভর না করেই বিদ্যুৎ উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারে। যেখানে অন্য গতানুগতিক ইঞ্জিনচালিত বাহনে বারবার জ্বালানী ভরার ঝক্কি লেগেই থাকে।
ওয়াটার ইঞ্জিনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা
হাইড্রোজেন উচ্চমাত্রায় দাহ্য। তাই হাইড্রোজেন ব্যবহার করতে হয় এমন যেকোনো কিছুতেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করা জরুরি। টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিন উচ্চ চাপের স্টোরেজ ব্যবহার করে না বলে, হাইড্রোজেন নিয়ে ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়। গাড়ির ইঞ্জিনে হাইড্রোজেনের সংরক্ষন করতেও যথেষ্ট নিরাপত্তা অবলম্বন করা হয়েছে। অন্তত এমনটাই দাবি করেছে টয়োটা কোম্পানি।
যদিও টয়োটার এই ওয়াটার ইঞ্জিনে প্রাথমিক বিনিয়োগ খুবই ব্যয়হুল হতে পারে। তবে এর দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা কিন্তু অনেক। যেমন, অন্যান্য সাধারণ ইঞ্জিনের গাড়ির তুলনায় টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিনচালিত গাড়ির জালানীর খরচ ও অপারেটিং খরচ হবে একদমই কম। সাথে পরিবেশগত প্রভাব তো আছেই। যা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
টয়োটা মিরাই ২০২৪ (Toyota Mirai 2024)
কতজন জানেন এই ব্যাপারে জানি না, তবে টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিনচালিত গাড়ি কিন্তু চলতি বছরেই ইতোমধ্যে বাজারে চলে এসেছে। টয়োটা মিরাই নামক অদ্ভুত এই গাড়িতে জ্বালানী ভরতে সময় লাগে মাত্র ৫ মিনিটের মতো। যা অন্যান্য ইঞ্জিনচালিত গাড়ির চাইতে উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। একটি সিঙ্গেল হাইড্রোজেন ট্যাঙ্ক দিয়ে এই গাড়ি ৪০২ মাইল দীর্ঘ পথ চলতে পারে। পানিতে ইঞ্জিন চলা ছাড়াও, গাড়ির সামনে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ ও পথচারি শনাক্তসহ আরো অনেক অত্ত্যাধুনিক ফিচার রয়েছে এই টয়োটা মিরাই গাড়িটিতে।
ওয়াটার ইঞ্জিনচালিত টয়োটার এই অত্যাধুনিক গাড়িটির দাম শুরু হয়েছে ৫০১৯০ ডলার থেকে। এর সাথেই টয়োটা ক্রেতাদের একটি কমপ্লিমেন্টারি প্যাকেজ অফার করে। যার মধ্যে রয়েছে ১৫০০০ ডলার মূল্যের হাইড্রোজেন জ্বালানী, ৬ বছরের জন্য। যদি কেউ গাড়ি লিজ নিতে চায়, তার জন্যেও রয়েছে ৩ বছরের জন্য এই প্যাকেজ। এছাড়াও এই গাড়ির ক্রেতাদের জন্য রয়েছে ৮ বছর ও ১০ হাজার মাইলের ওয়ারেন্টি।
নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির গতিশীলতায় একটি বড় ধাপ অতিক্রম করছে টয়োটা তাদের এই ওয়াটার ইঞ্জিনের মাধ্যমে। যে পানিকে পরিবেশের বন্ধু আর ইঞ্জিনের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই পানি দিয়েই যদি ইঞ্জিন চলে, তাহলে সেটা প্রযুক্তির ইতিহাসে কতটা বড় জায়গা দখল করে নিবে, তা আর বলার বাকি রাখে না। হয়তো এভাবেই আমরা প্রযুক্তিকে সাথে নিয়েই একটি পরিবেশবান্ধব সবুজ ভবিষ্যতের দিকে এগোতে যাচ্ছি। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ইলেকট্রিক হাইব্রিড গাড়ি বাজারে আনা টয়োটা যেন আরো একবার ইতিহাস নতুন করে লিখছে এই ওয়াটার ইঞ্জিনচালিত গাড়ির মাধ্যমে।