প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সবকিছুই স্মার্ট। এমনকি মার্কেটের বেশিরভাগ গাড়িকেই এখন স্মার্ট গাড়ি হিসেবে ধরে নেয়া যায়। তাহলে গাড়ি পার্ক করার স্পেস কেনো স্মার্ট হবে না? জ্বি হ্যা, গাড়ি পার্কিং-এর ক্ষেত্রেও এখন লেগেছে স্মার্টনেস-এর ছোয়া। আজকের লেখায় আমরা স্মার্ট পার্কিং সম্পর্কে জানবো এবং কিছু স্মার্ট পার্কিং প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হবো।
স্মার্ট পার্কিং সিস্টেম কী?
ইন্টারনেট অফ থিংকস (Internet of Things) ও সেন্সর প্রযুক্তির ব্যবহার করে মানুষের কোনো অংশগ্রহণ ছাড়া অথবা খুব কম অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এভেইলএবল পার্কিং স্পেসের সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবহারের ধারণাকে বলা হয় স্মার্ট পার্কিং সিস্টেম (Smart Parking System)। মূলত IoT এবং সেন্সর প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ডিভাইসে বাধাবিহীন ডেটা আদান-প্রদানের মাধ্যমে এই সিস্টেম কাজ করে থাকে। স্মার্ট ডিভাইস, স্মার্ট গাড়ি, ড্রাইভার এবং পার্কিং স্পেস প্রোভাইডারের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটি কাজ করে থাকে। বিষয়টি ঠিক স্পষ্ট হলো না, তাই তো? তাহলে চলুন সংজ্ঞা পড়া বাদ দিয়ে কিছু স্মার্ট পার্কিং প্রযুক্তির প্র্যাক্টিকাল উদাহরণ দেখে আসি।
গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থাপনায় কিছু প্রযুক্তির পরিচিতি
বিশ্বের যেকোনো বড় শহরের জন্য গাড়ি পার্কিং একটি বড় সমস্যা। জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সড়কে গাড়ির পরিমাণ বেড়ে চলেছে। তবে সেই তুলনায় শহরে পার্কিং স্পেস বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, জায়গা তো সীমিত! যার ফলে বেশিরভাগ মানুষই তাদের গন্তব্যস্থলের কাছাকাছি কোথাও গাড়ি পার্ক করার স্পেস পান না। গন্তব্যস্থল থেকে কিছুটা দুরত্বে গাড়ি পার্ক করেই তাদের হেটেঁ বা রিকশায় করে গন্তব্যে পৌছাতে হয়। চলুন জেনে নেই আধুনিক কি কি প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে পার্কিং ব্যবস্থাপনায়ঃ
১। চালকবিহীন পার্কিং (Driverless Parking)
চালকবিহীন পার্কিং (Driverless Parking) প্রযুক্তির সাহায্যে গাড়ি নিজে নিজেই শূণ্য পার্কিং স্পেস খুঁজে বের করে এবং নিজেকে পার্ক করে। এই প্রযুক্তির সাহায্য ড্রাইভারদের প্রচুর পরিমাণ সময় সেইভ করা সম্ভব হয়। কারণ, ড্রাইভারকে আর গাড়িতে বসে স্পেস খোঁজা নিয়ে সময় ব্যয় করতে হয় না। ক্যামেরা এবং সেন্সরের ব্যবহার করার মাধ্যমে গাড়ি নিজেই নিজেকে পার্ক করে ফেলে।
লেজার সেন্সর (Laser Sensor) ব্যবহার করার মাধ্যমে গাড়ি তার আশেপাশের পরিবেশকে স্ক্যান করে এবং পার্কিং স্পেস ডিটেক্ট করে। আবার ক্যামেরার মাধ্যমে যাচাই করে দেখে যে গাড়িটি সঠিকভাবে পার্ক করা হয়েছে কি না। বর্তমানে Bosch এবং Daimler নামক দুইটি কোম্পানি এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে।
২। স্মার্ট সেন্সর (Smart Sensor)
চালকবিহীন পার্কিং প্রযুক্তি সাধারণত প্রতিটি গাড়িতে ইন্ডিভিজুয়ালি দেয়া থাকে। তবে স্মার্ট সেন্সর কোনো নির্দিষ্ট গাড়িতে নয়, বরং লাগানো থাকে পার্কিং লটে। স্মার্ট সেন্সর জিপিএস প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ড্রাইভারের লোকেশান ট্র্যাক করে এবং সেই অনুসারে খালি পার্কিং স্পেস সম্পর্কে ড্রাইভারকে নোটিফিকেশন অথবা সিগনাল পাঠায়। এতে করে ড্রাইভারকে আর প্রতিটি সারি আলাদা আলাদা করে চেক করতে হয় না। পার্কিং লটে প্রবেশের সাথে সাথেই তিনি জেনে যান যে কোথায় স্পেস আছে।
৩। পার্কিং অ্যাপস (Parking Apps)
এটি স্মার্ট সেন্সর এবং ড্রাইভারলেস পার্কিং-এর সাথে কম্বাইন করে তৈরি করা একটি প্রযুক্তি। এক্ষেত্রে আপনার স্মার্টফোনে একটি অ্যাপ্লিকেশন ইন্সটল করা থাকবে, যেখানে আপনি দেখতে পারবেন যে কোথায় পার্কিং স্পেস আছে (স্মার্ট সেন্সরের ব্যবহার) এবং গাড়ি পার্ক করা হয়ে গেলে নোটিফিকেশন পাবেন যে গাড়িটি সঠিকভাবে পার্ক করা হয়েছে (ড্রাইভারলেস পার্কিং-এর ব্যবহার)।
বিভিন্ন কোম্পানী ইতোমধ্যে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে এই সেবা দিতে শুরু করেছে। গাড়ির অপারেটিং সিস্টেমের সাথে স্মার্টফোনের অ্যাপ্লিকেশন ইন্টগ্রেট করে এবং পার্কিং লট থেকে সেন্সর ডাটা নেয়ার মাধ্যমে তারা সেই সেবা দিতে পারছে।
৪। কার পার্কিং লিফট (Car Parking Lifts)
স্বল্প পরিমাণ পার্কিং স্পেসের যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব এই কার পার্কিং লিফট প্রযুক্তির সাহায্য। কোনো টিনশেড বাড়িতে যেই পরিমাণ মানুষ বসবাস করতে পারেন, সেই একই পরিমাণ স্থানে একটি বিল্ডিং তৈরি করলে সেখানে আরো বেশি সংখ্যক মানুষের বসবাস করা সম্ভব। এই একই কনসেপ্টের ব্যবহার হয়েছে এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রে সীমিত পরিমাণ স্থানে একটি দুই তলা বা তিন তলা বিশিষ্ট পার্কিং গ্যারেজ তৈরি করা হয়। কোনো গাড়ি পার্ক করতে এলে সেটিকে লিফটের সাহায্যে উপরের তলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। আবার যখন গাড়ি পার্কিং থেকে বের করা হবে, তখন লিফটের সাহায্য গাড়ি নিচে নামিয়ে আনা হয়।
৫। ক্যাশলেস পেমেন্ট সিস্টেম (Cashless Payment System)
কোথাও গাড়ি পার্ক করতে চাইলে আপনাকে পার্কিং স্পেস ভাড়া নিতে হয়। এই সিস্টেমে পার্কিং স্পেস প্রোভাইডার দিনভিত্তিক, সাপ্তাহিক অথবা মাসিক হিসেবে রেন্ট চার্জ করে থাকেন। তবে এই পদ্ধতির অন্যতম অসুবিধা হচ্ছে, আপনি যতোটুকু সময় গাড়ি পার্ক করবেন, তার থেকে বেশি সময়ের টাকা আপনাকে দিতে হচ্ছে। এর সমাধান হিসেবে এসেছে ক্যাশলেস পেমেন্ট সিস্টেম।
এই ক্ষেত্রে, আপনি প্রোভাইডারের কাছে আপনার তথ্য দিয়ে রেজিস্টার করবেন এবং পেমেন্ট সিস্টেম সেট করে দিবেন। তার বিপরীতে প্রোভাইডার আপনার গাড়িতে একটি QR কোড লাগিয়ে দিবেন। এরপর থেকে যখনই আপনি পার্কিং স্পেসে গাড়ি পার্ক করবেন, গাড়িতে থাকা QR কোডের সাহায্যে প্রোভাইডার তা জেনে যাবেন। আর যখন আপনি গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাবেন, ঠিক ততোটা সময় হিসেবেই প্রোভাইডার আপনার পার্কিং ফি চার্জ করবেন, যা হতে পারে মিনিটভিত্তিক বা ঘন্টাভিত্তিক। পেমেন্ট অটোমেটিকালি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা কার্ড থেকে কেটে নেয়া হবে।
৬। পার্কিং রোবট (Parking Robots)
এই প্রযুক্তি অনেকটা ড্রাইভারলেস পার্কিং প্রযুক্তির মতোই। তবে ড্রাইভারলেস পার্কিং সিস্টেম কিন্তু সব গাড়িতে থাকে না। তো যেসব গাড়িতে ড্রাইভারলেস পার্কিং প্রযুক্তি নেই, সেখানে পার্কিং রোবট একই সেবা প্রদান করতে পারে। এই ক্ষেত্রে, আপনি পার্কিং স্পেসের কাছে এসে একটি রোবটকে গাড়ি দিয়ে যাবেন। রোবট নিজ দায়িত্ব এভেইলএবল সবচেয়ে ভালো স্থানে আপনার গাড়িটি পার্ক করে দিয়ে আসবে। এতে করে আপনার অনেক সময় বেচে যাবে।
আর এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যে, মানুষ পার্ক করলে স্পেস অনেক বেশি খরচ হয়। অপরদিকে, রোবট খুব কম স্পেস ব্যবহার করে অ্যাকুরেটলি গাড়ি পার্ক করতে পারে। ইতোমধ্যে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে এই প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে।
পরিসংহার
উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই ইতোমধ্যে স্মার্ট পার্কিং প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট পার্কিং সল্যুশন দিচ্ছে অন্যরকম ইলেকট্রনিক্স কোঃ লিঃ। সরকারি পর্যায় থেকে এই বিষয়ে বিভিন্ন ইনসেনটিভ দেয়া যেতে পারে। ঢাকা শহরের অত্যধিক পরিমাণ ট্রাফিক সুষ্ঠুভাবে মেইনটেইন করার জন্য এটি একটি গুরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।