প্রতিটি আবিষ্কারের পেছনেই একটি ইতিহাস থাকে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির যেই উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছে, তা মূলত ভিন্ন ভিন্ন প্রযুক্তির আবিষ্কারের সামষ্টিক রূপ। তেমনই একটি প্রযুক্তি হচ্ছে ভেইকেল ট্র্যাকিং সার্ভিস। ভেইকেল ট্রাফিক সার্ভিসের এই বিপুল প্রসারের ক্ষেত্রেও রয়েছে জিপিএস প্রযুক্তির অবদান। ব্যক্তিগত বা কমার্শিয়াল গাড়ি ট্র্যাক করার জন্য এখন খুবই প্রয়োজনীয় এবং সুপরিচিত একটি মাধ্যম হচ্ছে প্রহরী ভেইকেলে ট্র্যাকিং সার্ভিস। চুরি যাওয়া কোম্পানির বা ব্যক্তিগত গাড়ির সন্ধান, পণ্য ডেলিভারি, গাড়ির সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ, গাড়ির কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমাতে ভেইকেল ট্র্যাকিং সার্ভিস গাড়ির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু কীভাবে শুরু হয়েছিল ভেইকেল ট্র্যাকিং সার্ভিস, সেই ইতিহাস কজনেরই বা জানা আছে। চলুন জেনে নেয়া যাক কীভাবে শুরু হয়েছিল ভেইকেল ট্র্যাকিং সার্ভিস।
জিপিএস প্রযুক্তির সূচনা
ভেইকেল ট্র্যাকিং সার্ভিসের জন্য সবচাইতে দরকারি প্রযুক্তির নাম হচ্ছে জিপিএস প্রযুক্তি। মূলত জিপিএসই ভেইকেল ট্র্যাকিং সার্ভিসের মেরুদণ্ড। এই জিপিএস সিস্টেম আবিষ্কারের কাহিনী খুব একটা নতুন না। জিপিএস প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথা সর্বপ্রথম ভাবা হয়েছিল আজ থেকেও ষাট-সত্তর বছর আগে। এবং প্রথম জিপিএস স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল ১৯৭০ এর দশকে। তবে ভেইকেল ট্র্যাকিং এর জন্য জিপিএস ব্যবহারের কথা ভাবা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। সেই বছরে সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলক জিপিএস স্যাটেলাইট ব্লক-১ মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৮৫ সালের মধ্যে আরো ১০ টি ব্লক-১ জিপিএস স্যাটেলাইট সফলভাবে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। এই জিপিএস স্যাটেলাইটগুলো মহাকাশে পাঠানোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সামরিক ক্ষেত্রে গাড়ি ট্র্যাক করার জন্য। কিন্তু অনেক গাড়ি ট্র্যাক করার মতো বৃহৎ পরিসরে সেগুলো ব্যবহার করা যেত না। কারণ বড় পরিসরে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জিপিএস স্যাটেলাইট তখনো ছিল না। পরবর্তীতে পুরোপুরিভাবে সমৃদ্ধ জিপিএস প্রযুক্তি পেতে সময় লেগেছে আরো নয় বছর। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ফোর্সের পাঠানো ব্লক-২ নামক জিপিএস স্যাটেলাইট জিপিএস প্রযুক্তিকে সম্পূর্ণ একটি রূপ দান করে।
জিপিএস’র প্রসারে বিল ক্লিন্টন
আগেই বলা হয়েছে যে, প্রথমদিকে জিপিএস ব্যবহার করা হত সামরিক বাহিনী কর্তৃক তাদের দরকারি গাড়িগুলোর উপরে নজর রাখার জন্য। সাধারণ জনগণ তখন জিপিএস সম্পর্কে অবগত থাকলেও ব্যবহার করতে পারতো না। সামরিক অধীনে থাকার ফলে এটির উপর মানুষের আগ্রহও খুব একটা ছিল না। কিন্তু ১৯৯৬ সালে, তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন সর্বপ্রথম জনসাধারণের কাছে জিপিএস এর উপযোগিতা তুলে ধরেন। পাশাপাশি একটি ডুয়াল-ইউজ জিপিএস স্থাপনের পলিসি গ্রহণ করেছিলেন। এতে করে সামরিক এবং জনসাধারণ দুই ভাবেই জিপিএস ব্যাবহারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এর ফলে তখন থেকে সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ জনগণের কাছে জিপিএস প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার স্থাপিত হয়েছিল এবং ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজাররাও তাদের অধীনে থাকা গাড়ি ট্র্যাক করার জন্য এর উপরে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল।
ভেইকেল ট্র্যাকিং এ জিপিএস’র প্রসার
বিল ক্লিন্টন কর্তৃক পলিসি ইস্যু হবার পর, সবার কাছেই জিপিএস এর ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল কিন্তু সেই সময়ে জিপিএস ব্যবহারের খরচ ছিল অনেক বেশি। এর পাশাপাশি গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জিপিএস ট্র্যাকিং ব্যবহার করতে হলে গাড়িতে বিশালাকার, ভারী এবং গাড়ির সাথে মানান সই নয় এমন ডিভাইস ব্যবহার করতে হত এবং ডিভাসটির জন্য খুবই উচ্চমূল্য প্রদান করতে হত। এর সাথে ধীর গতির ইন্টারনেট এবং তৎকালীন ধীর প্রকৃতির কম্পিউটার প্রযুক্তির কারণে সকলের কাছে জিপিএস থাকলেও সবাই ব্যবহার করতে পারতো না। শুধুমাত্র ধনী কোম্পানিগুলো জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করে গাড়ি ট্র্যাক করতো। আর ছোট এবং মাঝারি কোম্পানিগুলো অপেক্ষা করছিল কবে এই প্রযুক্তি আরো সহজলভ্য হবে সেই আশায়।
অবশেষে ভাগক্রমে এর প্রায় দুই যুগ পার হয়ে গেছে এবং জিপিএস এর মাধ্যমে ভেইকেল ট্র্যাকিং সার্ভিস সকলের কাছে পৌঁছাবারও একটি ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। জিপিএস সিস্টেমের উন্নতি এবং অগ্রগতির দরুন এর দাম কমেছে। এর সাথে কম্পিউটার প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট এক্সেসিবিলিটির ব্যাপক প্রসারের দরুন গাড়িতে ভেইকেল ট্র্যাকার ব্যবহার এখন অনেকটাই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। ছোট-বড় হাজারো কোম্পানি এই জিপিএস ভেইকেল ট্র্যাকিং সার্ভিস ব্যবহার করছে তাদের গাড়ি ট্র্যাক করার জন্য। এটির সহজলভ্যতা এতটাই ব্যাপক হয়েছে যে, কোম্পানির গাড়ি তো বটেই, ব্যক্তিগত গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশে এখন প্রহরী জিপিএস ভেইকেল ট্র্যাকিং ডিভাইস এবং সার্ভিস ব্যবহার করা হচ্ছে।