বিগত কয়েক বছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে এর অন্যতম কারন হচ্ছে ট্রাফিক আইন না মানা। বাংলাদেশে বিশেষ করে, শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সমানুপাতিক হারে যানবাহনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু, যানবাহন বাড়লেও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে আগের মতোই, যার কারণেই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা, বেঘোরে যাচ্ছে প্রাণ।
যদিও সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিবহন ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু ট্রাফিক রুলস ঠিক করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু মানুষ সেই সকল নিয়মের যথাযথ পালন করছে না এবং এই আইন না মানার ফলেই মূলত সড়ক দুর্ঘটনাগুলো সংঘটিত হচ্ছে। আমরা এই লেখায় দেখবো ট্রাফিক রুলস অমান্য করার পরিণতি কী হতে পারে। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পুরো আর্টিকেল জুড়ে আমাদের সঙ্গেই থাকুন।
ট্রাফিক রুলস অমান্য করার পরিণতি যে অত্যন্ত ভয়ানক হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। কারণ, ট্রাফিক রুলস ভাঙার ফলেই মূলত সড়কপথে দূর্ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়ে থাকে এবং সেই সড়ক দুর্ঘটনাগুলোতেই মৃত্যুবরণ করে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ। ইনকিলাবের ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় এক বছরে বারো হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। সর্বশেষ ২০২১ সালে রোড ফর সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৬ হাজার ২৮৪ জন যা তার আগের বছরের তুলনায় ৩০% বেশি অর্থাৎ, সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে।
১৯৮৩ সালে সরকার কর্তৃক সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে এবং সড়কে যান চলাচলের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “মোটরযান আইন ১৯৮৩” বাস্তবায়ন করা হয়। এই আইনে কিছু বিধিমালা প্রণয়ন করে দেওয়া হয়েছে এবং সেই বিধিমালা অনুযায়ী, ট্রাফিক আইন না মানলে নির্ধারিত কিছু শাস্তির কথাও সেখানে উঠে এসেছে, সেসকল শাস্তিসমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে তুলে ধরা হলো।
ট্রাফিক আইন ভঙ্গের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসমূহ
১) নিষিদ্ধ হর্ন/হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে ১০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৩৯)
২) আদেশ অমান্য বাধা সৃষ্টি ও তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ৪০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৪০ এর ১)
৩) ওয়ানওয়ে সড়কের বিপরীত দিকে গাড়ি চালালে ২০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৪০ এর ২)
৪) অতিরিক্ত গতি বা নির্ধারিত গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালালে ৩০০ টাকা জরিমানা, অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে ৫০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৪২)
৫) দুর্ঘটনা সংক্রান্ত যেসব অপরাধে থানায় ব্যবস্থা নেয়া হয় নাই, সেসব অপরাধে ৫০০ টাকা জরিমানা, অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে ১০০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৪৬)
৬) নিরাপত্তা বিহীন অবস্থায় গাড়ি চালালে ২৫০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা (ধারা ১৪৯)
৭) কালো বা অতিরিক্ত ধোঁয়া বের হওয়া মোটরযান ব্যবহারে ২০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৫০)
৮) মোটরযান আইনের সাথে সঙ্গতিবিহীন অবস্থায় গাড়ি বিক্রয় বা ব্যবহার, গাড়ির পরিবর্তন সাধনে ২০০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৫১)
৯) রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট বা ফিটনেস সার্টিফিকেট অথবা রুট পারমিট ব্যতীত মোটরযান ব্যবহারে ১৫০০ টাকা জরিমানা, অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে ২৫০০ জরিমানা (ধারা ১৫২)
১০) অনুমোদনহীন এজেন্ট বা ক্যানভাসার নিয়োগ করলে ৫০০ টাকা জরিমানা, অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে ১০০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৫৩)
১১) অতিরিক্ত মাল বা অনুমোদিত ওজন অতিক্রমপূর্বক গাড়ি চালালে ১০০০ টাকা জরিমানা, অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে ২০০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৫৪)
১২) বীমা ব্যতীত গাড়ি চালানো- ৭৫০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৫৫)
১৩) অনুমতি ব্যতীত গাড়ি চালানো- ৭৫০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৫৬)
১৪) প্রকাশ্য সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে ৫০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৫৭)
১৫) গাড়ির ব্রেক কিংবা কোনো যন্ত্র অথবা গাড়ির বডি কিংবা স্পিড গভর্নর সিল বা ট্যাক্সি মিটারের ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ করা- ৫০০ টাকা জরিমানা (ধারা ১৫৮)
এছাড়াও, যেসব অপরাধের মোটরযান আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই, সে ক্ষেত্রে ১৩৭ ধারায় জরিমানা ২০০ টাকা এবং অপরাধের পুনরাবৃত্তিতে জরিমানা ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মোটরযান আইন বাস্তবায়ন হয়েছে কি?
আইন প্রণীত হলেও উপরিউল্লিখিত শাস্তিসমূহের যথাযথ ব্যবহার বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত নয় যার ফলে চালকগণ ট্রাফিক রুলস ভঙ্গ করতে কোনো দ্বিধাবোধ করে না যার ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমার পরিবর্তে আরো বেড়েই চলেছে। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের তোপে সরকার সড়ক নিরাপত্তায় আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং ২০১৯ সাল থেকে “সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮” কার্যকর করা হয় যা মূলত ১৯৮৩ সালের মোটরযান আইনেরই সংশোধিত রূপ। এই আইনে ট্রাফিক রুলস অমান্য করার সাজা বাড়ানো হয়েছে এবং সাজাগুলোর যথাযথ প্রয়োগের ব্যাপারে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে।
নিরাপদ সড়ক আইন ২০১৮
১) নতুন আইন অনুযায়ী ট্রাফিক সংকেত ভঙ্গের জরিমানা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার করা হয়েছে, এছাড়াও হেলমেট না পরে মোটর সাইকেল চালালে জরিমানা ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। সিটবেল্ট না বাঁধলে কিংবা যান চালনারত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে চালককে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা গুণতে হবে।
২) বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করলে তিন লাখ টাকা জরিমানা ও তিন বছরের জেল হতে পারে। নতুন আইনে চালকদের লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি, সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে।
৩) ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হয়েছে এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট রাখা হয়েছে। আইন ভঙ্গ করলে জেল-জরিমানা ছাড়াও সেখান থেকে পয়েন্ট কাটা যাবে এবং পুরো ১২ পয়েন্ট কাটা গেলে লাইসেন্স বাতিল। এর পাশাপাশি, চালক ও তার সহকারীকে প্রমাণস্বরূপ নিয়োগপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ধারা ১৪ এর বিধান অনুযায়ী কন্ডাক্টর লাইসেন্স ব্যতিত কোনো গণপরিবহণে কন্ডাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৪) রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরযান চালনা করলে ধারা ১৬ অনুযায়ী চালক সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৫) যদি কেউ ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার ও প্রদর্শনে বিধি-নিষেধ সংক্রান্ত ধারা ১৭ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ দুই বছর তবে কমপক্ষে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা তবে কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
৬) মোটরযানের ফিটনেস সনদ ছাড়া বা মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেস সনদ ব্যবহার করে বা ইকোনমিক লাইফ অতিক্রান্ত বা ফিটনেসের অনুপযোগী, ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালনা সংক্রান্ত ধারা ২৫ এর বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
৭) রুট পারমিট ছাড়া পাবলিক প্লেসে পরিবহন যান ব্যবহার করা হলে ধারা ২৮ এর উপ-ধারা (১) এর বিধান অনুযায়ী, দোষীকে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
৮) মোটরযানের বাণিজ্যিক ব্যবহার সংক্রান্ত ধারা ৩১ এর বিধান লঙ্ঘনের দণ্ড- যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৩১ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কাটা হবে।
ট্রাফিক আইন বাস্তবায়ন ও উপসংহার
বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন হওয়া সহজ কিন্তু এর বাস্তবায়ন সহজ নয়। এতকিছুর পরও ট্রাফিক রুলসের যথাযথ পালন হচ্ছে না এবং বেপরোয়া যান চলাচলও বন্ধ করা যাচ্ছে না। এরপরেও কিছু অসাধু চালক কিংবা পরিবহনমালিক জরিমানা দিয়ে কিংবা অসদুপায় অবলম্বন করে ট্রাফিক রুলস ভঙ্গ করেও ছাড়া পেয়ে যায় কিংবা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। দেশের সুনির্ধারিত আইন অমান্যকারী কোনো অপরাধী যেন সহজে ছাড়া না পায় সেজন্য প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। এর পাশাপাশি চালকদেরও বুঝতে হবে যে, ট্রাফিক রুলস অমান্য করলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে আর কারো জীবনের মূল্য কোনো কিছু দিয়েই চুকানো সম্ভব নয়, হাজার জরিমানা দিয়েও নয়।
শখের গাড়ির সকল তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে এবং গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী ব্যবহার করতে পারেন। এটি একটি ভেহিক্যাল ট্র্যাকার সার্ভিস (VTS) ডিভাইস যা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে পাই ল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রহরী – ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং সিস্টেমে রয়েছে অ্যাপের মাধ্যমে ইঞ্জিন লক/আনলক করার সুবিধা, গাড়ির লাইভ ট্র্যাকিং আপডেট দেখা, এবং ট্রাভেল হিস্টোরি চেক করা সহ আরও অনেক সুবিধা বিস্তারিত জানতে দেখুন প্রহরী প্যাকেজ সমূহ।