প্রহরী

পড়তে লাগবে: 5 মিনিট

ক্র্যাক প্লাটুন: অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল – ৯ জুন, ১৯৭১

“দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল”! কে বলেছিলেন এই কথা জানেন? মুক্তিবাহিনীর ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এবং ‘কে-ফোর্স’-এর সর্বাধিনায়ক, বীরউত্তম খালেদ মোশারফ। সেই থেকে ‘ক্র্যাক প্লাটুনের’ শুরু। এযুগের ‘অ্যাভেঞ্জারস এসেম্বল’ শুনে গায়ের লোমে কাঁটা দেয়া ছেলেমেয়েরা কী জানে, ১৯৭১ সালেও নিজের দেশের জন্য রাস্তায় নেমেছিলো একদল সুপার হিরো? যাদের ছিলো না ওড়ার ক্ষমতা, না ছিলো কোন জাদুকরি হ্যামার। আরে! যুদ্ধ করার জন্য নুন্যতম যে অস্ত্রশস্ত্র এবং ট্রেইনিং প্রয়োজন, তাই তো ছিলো তাদের নামেমাত্র। কিন্তু তাদের ছিল, নিজ দেশের জন্য জীবন দেয়ার মতো বুকভরা সাহস ও অকুতোভয় দৃঢ়তা।

ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যদের একাংশ
ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যদের একাংশ: Image Source: Daily Star

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন ও তাঁর পরবর্তী সময়ে কিংবদন্তীতে পরিণত হওয়া ক্র্যাক প্লাটুন দলের অসংখ্য অপারেশনের মধ্যে একটির গল্প শুনুন আজ, অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল

ক্র্যাক প্লাটুন এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সেই অপারেশনঃ

ক্র্যাক প্লাটুন নামের দলটি গঠনের পেছনে মূল ভূমিকা বীরউত্তম খালেদ মোশারফ এবং বীরউত্তম এটিএম হায়দারের। ৩৪ জনের কমান্ডো নিয়ে গঠিত বিশেষায়িত এই গেরিলা দলটি ছিল মূলত ২ নং সেক্টর, অর্থাৎ ঢাকা ভিত্তিক। খালেদ মোশারফের অধিনেই তারা মেলাঘরে গেরিলা ট্রেইনিং নেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঢাকা এব এবং ঢাকার আশে পাশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দখলে থাকা বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা ট্রেইনিং কাজে লাগিয়ে ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে অনেকগুলি সফল ঝটিকা আক্রমণ সংগঠিত করেন ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা কোমান্ডোরা। তবে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সেই অপারেশনে সরাসরি সম্মুখভাবে অংশ নেয় ১৭ জন।

ক্র্যাক প্লাটুন অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেটাল

ওরা ১৭ জনঃ

১৭ জন গেরিলার দলটিতে ছিলেন, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দীন, মাহবুব আহমাদ (শহীদ), শ্যামল, ভাষণ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাট্যকার অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে), ফতেহ আলী চৌধুরী, আবু সাইদ খান, আনোয়ার রহমান (আনু), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), ইঞ্জিনিয়ার সিরাজ, গোলাম দস্তগীর গাজী, তারেক এম আর চৌধুরী, নজিবুল হক, রেজা, আব্দুস সামাদ, জব্বার, ইফতেখার এবং হাবিবুল আলম। সেক্টর কমান্ডার এবং ‘কে-ফোর্স’-এর সর্বাধিনায়ক, বীরউত্তম খালেদ মোশারফ এদের উপর ন্যাস্ত করেছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। করতে হবে এমন কিছু, যা কখনো দেখেনি বা শোনেনি ঢাকাবাসী, যা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চিন্তারও ঊর্ধ্বে।

ক্র্যাকপ্লাটুন সদস্যদের ছবি

মাত্র ১২টি ‘পাইন আপেল টাইপ’ হ্যান্ড গ্রেনেড, একটি করে বেয়নেট এবং তৎকালীন পাকিস্তানী মুদ্রায় ১৬০ রূপি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা সবাই ঢাকায় পৌছায় ৩ জুন, ১৯৭১ এ।

লক্ষ্য কেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালঃ

মূল লক্ষ্য আসলে ছিল ঢাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা। পুরো বিশ্বের নজর ঢাকা ও স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের দিকে ঘুরিয়ে আনা। এই উদ্দেশ্যেই মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর এটিএম হায়দার ক্র্যাক প্লাটুনের কমান্ডোদের ঢাকা শহরে প্রেরণ করেন। তবে যেন পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে না জড়ায় গেরিলারা, এব্যাপারে ছিল কড়া অর্ডার। কারণ, পর্যাপ্ত অস্ত্রের অভাব। আরেকটি কারণ ছিলো, যুদ্ধের শুরুতেই এতো স্বল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মুখোমুখি না হওয়া।

ক্র্যাক প্লাটুন অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেটাল

কমান্ডোদের জানানো হয় যে, পাকিস্তান সরকারের আহ্বানে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বেশ কিছু প্রতিনিধি অবস্থান করবেন ঢাকায়, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (সাবেক হোটেল শেরাটন এবং বর্তমানে রূপসী বাংলা)। পাকিস্তান সরকার মূলত তাদেরকে বোঝাতে চাইছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে সবকিছু। এসব কিছু জেনেই ক্র্যাক প্লাটুন সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এয় যে, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ৬ থেকে ৮ মাইলের মধ্যেই চালানো হবে বড়সড় একটি অপারেশন। যেন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা বুঝতে পারে যে, এই পূর্ব পাকিস্তান আর পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রনে নেই। এদেশের মানুষ রুখে দাড়িয়ে গেছে পাকিস্তান সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে।

অবশেষে ৯ জুন, ১৯৭১

কমান্ডার খালেদ মোশারফ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ৬ থেকে ৮ মাইলের মধ্যে আক্রমণ করতে বললেও, এলাকা রেকি করতে গিয়ে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন যে, অপারেশন চালাতে হলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই চালাবেন! ঝুঁকি নিবেনই যখন, তাহলে অত দূরে যাবেন কেন?

৯ জুন, ১৯৭১। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। অন্ধকার ঘনিয়ে এলো প্রায়। এগিয়ে যাচ্ছে একটি গাড়ি। ঠিক আগের দিন, মানে ৮ জুন একটি নীল ডাটসান ১০০০ গাড়ি ছিনতাই করা হয়েছে। ড্রাইভারের সিটে এফডিসির ক্যামেরাম্যান বাদল, পাশের সিটে হাতে পিস্তল নিয়ে কামরুল হক স্বপন বসে। পেছনেই প্লাটুনের তিন সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), হাবিবুল আলম ও আলী আহমেদ জিয়াউদ্দীন বসা। পেছনের তিন জনের হাতে ৩টা করে মোট ৯ টা গ্রেনেড। গাড়িটি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভবন ছাড়িয়ে ডানে মোড় নিয়ে তিন রাস্তার মাঝের বড় রাস্তা পেরিয়ে বাম দিকে মোড় নেয়। শুরু হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সীমানা দেয়াল।

পুলিশের গাড়ি বহরের সাথে কয়টি গাড়ি আসতে দেখেই বোঝা গেলো, পাকিস্তান সরকারের সম্মানিত অতিথিরা আসছেন। রাস্তার পাশের দেয়াল ও ফুটপাতে অতিথিদের দেখতে আসা মানুষের ভিড়ে সেনাবাহিনী বা পুলিশের কেউ খেয়ালই করলো না কমান্ডো ভর্তি নীল রঙা গাড়িটি। এই সুযোগেই শার্প ইউটার্ন নিয়ে ফুটপাত সংলগ্ন হোটেলের পেছন দিকে এসে থামে। চারজন প্লাটুন সদস্য নিঃশব্দে হেঁটে হোটেলের পেছনের ছোট গেটটির কাছে এসে দাড়িয়ে যায়।

ততক্ষনে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের টেরেস ও এন্ট্রান্স গেইট বরাবর ৩ থেকে ৪ ফুট দূরে পজিশন নিয়ে নেন আরবান গেরিলা আলম, মায়া ও জিয়া। তাঁদের কিছু দুরেই স্বপন দাড়িয়ে, শার্টের আড়ালের পিস্তলের বাটে সাবধানে হাত রেখে। অতিথিদের গাড়ি কিছুটা থামতেই জিয়া পিন খোলা গ্রেনেড ছুড়ে দেন। প্রচন্দ বিস্ফোরণে মুহূর্তেই গাড়িটি লাফিয়ে উঠে টেরেসের কোনায় গিয়ে পড়ে। গাড়ি থেকে দুইজন বের হতে চেষ্টা করছে কি, আগে থেকে প্রস্তুত গেরিলা আলম ও মায়া পরপর ছুড়ে মারেন আরো দুটি গ্রেনেড। জিয়া, আলম ও মায়া মিলে পরপর ছুড়েন আরো কয়টি গ্রেনেড। একটার পর একটা গ্রেনেড বিস্ফোরণে ধোয়া ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারদিক। এর মাঝেই চারজন গেরিলা গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার বাদল এস্কেলেটরে পা চেপে টান দেন গাড়ি। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! শহরের এমন প্রাণকেন্দ্রে প্রথমবারের মতো এমন প্রত্যক্ষ গেরিলা আক্রমণ দেখা গেলো যে! বিবিসি ও অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও ঘটা করে প্রচার হয়েছিলো এই অভূতপূর্ব গেরিলা আক্রমনের খবর।

ক্র্যাকপ্লাটুন সদস্য

ক্র্যাক প্লাটুনকে কি আর শুধু শুধু ক্র্যাক বলা হতো? কথা ছিলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ৬ থেকে ৮ মাইলের মধ্যে আক্রমনের। সেটা তারা করলো ঠিক হোটেলের গা ঘেঁষে! তারপরই কী শেষ? পথিমধ্যে বেইলী রোডের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে সামরিক জান্তা সরকারের অন্যতম দৈণিক পত্রিকা মর্নিং নিউজ অফিসের পাশে নিয়ে আসেন তাঁরা। এরপর চলন্ত অবস্থায়ই গাড়ি স্লো করে পত্রিকা অফিসের সীমানা দেওয়ালের উপর দুটো গ্রেনেড ছুঁড়ে মারেন গেরিলা আলম। দ্রুত সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে মগবাজারের কাজী অফিসের পাশে জামায়াতের আমীর ও গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড গোলাম আজমের বাড়ির উপর দুটো পর পর দুটো গ্রেনেড ছোঁড়েন মায়া। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন বাসায় গোলাম আজম ছিল না। অতঃপর দ্রুতগতিতে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে প্ল্যানমত যে যার বাসায় চলে যান সেইদিনের বীরেরা।

অপারেশন শেষে কিছুদিনের মধ্যে ঢাকায় তুলকালাম করা বীরেরা মেলাঘরে ফিরে যান। যদিও মেলাঘরের সবাই ঘটনা আগেই শুনেছেন বিবিসি ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর বর্ণনায়। তবুও বীর গেরিলারা আরেকবার নিজেদের মুখে ঘটনার বর্ণনা করেন দলনেতা কমান্ডার বীরউত্তম মেজর খালেদ মোশারফ ও ক্যাপ্টেন হায়দারকে! কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা গর্বিত মেজর খালেদ মোশারফ নাকি রেডিওতে শুনেই বলেছিলেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে!

শখের গাড়ির সকল তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে এবং গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী ব্যবহার করতে পারেন। এটি একটি ভেহিক্যাল ট্র্যাকার সার্ভিস (VTS) ডিভাইস যা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে পাই ল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রহরী – ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং সিস্টেমে রয়েছে অ্যাপের মাধ্যমে ইঞ্জিন লক/আনলক করার সুবিধা, গাড়ির লাইভ ট্র্যাকিং আপডেট দেখা, এবং ট্রাভেল হিস্টোরি চেক করা সহ আরও অনেক সুবিধা বিস্তারিত জানতে দেখুন প্রহরী প্যাকেজ সমূহ।

    গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী সম্পর্কে জানতে

    Share your vote!


    এই লেখা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
    • Fascinated
    • Happy
    • Sad
    • Angry
    • Bored
    • Afraid

    মন্তব্যসমূহ

    Scroll to Top