আপনি যেহেতু এই ব্লগপোস্টটি পড়ছেন তার মানে হচ্ছে, আপনি গাড়ির প্রতি খুবই আসক্ত কিংবা আপনি গাড়ি খুব ভালোবাসেন। যেহেতু, ব্লগপোস্টের লেখকও গাড়ির ভক্ত খুব। তাই, ধরে নিতে পারেন দারুণ একটা ব্লগ পড়তে যাচ্ছেন। তাই ধৈর্য্য ধরে পুরো ব্লগপোস্টটি পড়লেই আপনি আজকে জেনে যাবেন, একটি গাড়ির ম্যানুয়াল এবং অটোমেটিক গিয়ার এর অদ্যপ্রান্ত। তাই চলুন শুরু করা যাক।
আমাদের মনে যখন গাড়ির প্রসঙ্গ আসে তখন দুটি বিষয় প্রথমে মনে প্রশ্ন আসে। প্রথমটি হচ্ছে গাড়িটিতে ম্যানুয়েল গিয়ারবক্স নাকি অটোমেটিক। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হয় গাড়ি তেলে চলে নাকি গ্যাসে। তবে এখন প্রযুক্তির কল্যাণে আরেকটি অপশন যুক্ত হয়েছে, তা হচ্ছে তেল, গ্যাস নাকি ইলেক্ট্রিক কার? সে যাই হোক, আজকের মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক, আপনি যদি কোন গাড়ি চালাতে যান, তবে প্রথমেই যে প্রশ্নের উত্তরটি আপনার জানা থাকতেই হবে সেটি হচ্ছে গাড়িটির গিয়ার সিস্টেম কী? ম্যানুয়েল গিয়ার নাকি অটোমেটিক গিয়ার। কেননা, এই প্রশ্নের উত্তরের উপরই নির্ভর করে গাড়িটির পুরো মেকানিজম বা পরিচালনা সিস্টেম। যদি আমরা সহজ ভাষায় বুঝার চেষ্টা করি তবে ম্যানুয়াল গিয়ার ও অটোমেটিক গিয়ার বলতে বুঝায়-
১. ম্যানুয়েল গিয়ার
গাড়ির যে গিয়ারবক্স চালকের প্রতিনিয়ত নির্দেশনার মাধ্যমে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করে তাকে ম্যানুয়েল গিয়ার বলে। এই গিয়ারে ইংরেজি বর্ণ আর (R) থেকে শুরু করে ৫,৬,৭ পর্যন্ত গিয়ার অঙ্কিত অবস্থায় থাকে। যেখানে সামনে পেছনে গিয়ার লিভার টানার মাধ্যমে গাড়ির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ম্যানুয়েল গিয়ার পুরোপুরি চালকের নির্দেশনার উপর নির্ভরশীল এবং এই গিয়ার সিস্টেমে শুধু গিয়ার লিভার টানলেই হয় না সাথে ক্লাচ ও এক্সেলেটর নামের দুটো আলাদা লিভারকেও প্রয়োজন মতো নির্দেশনা দিতে হয়। তাই বলা যায়, ম্যানুয়েল গিয়ার সিস্টেম একটু জটিল প্রক্রিয়া এবং ব্যবহারবিধি তুলনামূলক কঠিন।
ক. ম্যানুয়াল গিয়ারের সুবিধাসমূহ
- ম্যানুয়েল গিয়ারবক্স থাকা গাড়ির গতিবিধি প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তন করা যায় বলে, যখন যেমন গতিতে গাড়ি চালানোর প্রয়োজন তেমন গতিতে গাড়ি চালানো যায় ।
- যখন গাড়ি উচুতে উঠে তখন ০১ নাম্বার গিয়ারে গাড়ি চালালে গাড়ি যথেষ্ট শক্তি পায়।
- ম্যানুয়াল গিয়ারের গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ সহজ।
- ম্যানুয়াল গাড়ির গিয়ারবক্স সহজ নিয়মে কাজ করে বিধায় নষ্ট কিংবা অকেজো হলে ড্রাইভার নিজেই বা ছোট মেকানিক্সের কাছ থেকেই সহজে সারিয়ে তোলা যায়।
- গিয়ার লিভারে অঙ্কিত গিয়ার নাম্বার থাকায় শুধুমাত্র সামনে পেছনে শিপটিং করেই গিয়ার পরিবর্তন করা যায়, যা নতুন পুরাতন সকল ড্রাইভারদের জন্যই সহজ।
- ম্যানুয়াল গিয়ার প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয় বলে, ইঞ্জিন এবং গিয়ারবক্স দুটোই তুলনামূলক হিট কম উৎপাদন করে।
- সহজ মেকানিজম হওয়ায় ম্যানুয়াল গিয়ারের গাড়ির দাম তুলনামূলক কম।
- কেউ যদি গাড়ি চালানো শিখতে চান, তবে ম্যানুয়াল গিয়ারে গাড়ি চালানো শিখলে অটোমেটিক গিয়ারের গাড়ি সহজেই চালাতে পারেন।
- ব্যাটারি বসে যাওয়া কিংবা অন্য কোন কারণে গাড়ি স্টার্ট না নিলে, ০১ নাম্বার গিয়ারে গাড়ি রেখে থাক্কা দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করা যায়।
খ. ম্যানুয়াল গিয়ারের অসুবিধাসমূহ
- ম্যানুয়াল গিয়ারবক্সে গিয়ার শিপটিংয়ে খুবই সচেতনতার সহিত করতে হয়। যেখানে ক্লাচ চেপে, এক্সিলেটর কমিয়ে গিয়ার শিপট করতে হয়।
- ম্যানুয়েল গিয়ারে প্রতিনিয়ত গিয়ার শিপটিং করতে হয় বলে, চালককে গাড়ি চালানো অবস্থায় প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই গিয়ারের প্রতি তীক্ষ্ণ মনোযোগ রাখতে হয়।
- এই সিস্টেমে গিয়ার ক্রমানুসারে এবং গাড়ির গতিবিধির উপর ভিত্তি করে গিয়ার পরিবর্তন করতে হয়, না হয় গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ভাইব্রেশন করার মতো বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
- এই সিস্টেমে গিয়ার খুব সচেতনভাবে ফেলতে হয়, যদি নতুন চালক কিংবা অপারদর্শী কেউ ঘনঘন নিয়ম না মেনে গিয়ার শিপট করে তবে গিয়ারবক্স বাদ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- ম্যানুয়াল গিয়ার নিউট্রাল (N) করা তুলনামূলক কঠিন।
২. অটোমেটিক গিয়ার
গাড়ির যে গিয়ারবক্স শুধুমাত্র একটি নির্দেশনার মধ্য দিয়েই স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাকে অটোমেটিক গিয়ার সিস্টেম বলা হয়। অর্থ্যাৎ, যে গিয়ারবক্সে ইংরেজি বর্ণমালা পি (P), আর(R), ডি(D), এস(S), এল (L), (OD) ইত্যাদি বর্ণমালা অঙ্কিত থাকে এবং যেকোনো একটি নির্দেশনার মধ্য দিয়েই গাড়ি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রয়োজনমাফিক গাড়ির গতিবিধি কমাতে ও বাড়াতে পারে তাকে অটোমেটিক গিয়ার সিস্টেম বলে।
আশা করা যাচ্ছে, আপনি এখন ০২ প্রকারের গাড়িরই গিয়ার সিস্টেমের সাথে পরিচিতি লাভ করতে পেরেছেন। তবে এখন আমাদের জানতে হবে উভয় ধরণের গিয়ারবক্সের সুবিধা এবং অসুবিধা। তাহলে চলুন জেনে নেই ম্যানুয়াল এবং অটোমেটিক গিয়ারবক্সের সুবিধা এবং অসুবিধাসমূহ-
ক. অটোমেটিক গিয়ারের সুবিধাসমূহ
- অটোমেটিক গিয়ারবক্স বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় একটি গিয়ার সিস্টেম যেখানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে গিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে খুব সহজেই গাড়ি চালনা করা যায়।
- এই সিস্টেমে গিয়ারশিপটারে অঙ্কিত ইংরেজি বর্ণমালা যেমন- পি- পার্কিং P- Parking,, আর- রিভার্স, R- Rverse, এন- নিউট্রাল, N- Neutral,, ডি- ড্রাইভ, D-Dirve, এস- স্পোর্টস, S-Sports, এল- লো, L- Low, ওডি- ওভারলোড, OD- Overload Drive, মানে সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালনার নির্দেশনা দেয়া থাকে, যার ফলে খুব সহজেই এই নির্দেশনাসমূহ মেনে গাড়ি ড্রাইভ করা যায় কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই।
- অটো গিয়ারে একটি নির্দিষ্ট শিপটিংয়ে রেখে গাড়িকে দীর্ঘসময় পযন্ত ড্রাইভ করা যায় ফলে গিয়ার শিপটিং নিয়ে আলাদা মনোনিবেশ করতে হয় না।
- অটো গিয়ারে গিয়ারবক্স নিজে থেকেই গাড়ির প্রয়োজন অনুসারে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তাই আলাদা করে ড্রাইভারকে শিপটিংয়ের ঝামেলা পোহাতে হয় না।
- স্মুথ ড্রাইভিংয়ের জন্য অটোমেটিক গিয়ার সিস্টেম দারুণ কাজ করে। আলাদা করে ক্ষণে ক্ষণে গিয়ার শিপট করার ঝামেলা পোহাতে হয় না বলে এর জনপ্রিয়তা দিনদিন বেড়েই চলছে।
- অটো গিয়ারে ক্লাচের কাজ না থাকায়, বাম পায়ের কোন কাজ থাকে না। ফলে খুব আরাম করে গাড়ি চালানো যায়।
খ. অটো গিয়ারের অসুবিধাসমূহ
- অটো গিয়ারের গাড়ির গিয়ারবক্স খুবই জটিল প্রকৃতির ফলে নষ্ট হলে তা সারিয়ে তোলা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
- অটো গিয়ারে দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি একটা নির্দিষ্ট গিয়ারে শিপট থাকে বিধায় ইঞ্জিন এবং গিয়ারবক্স উভয়টিই অনেক বেশি হিট উৎপাদন করে।
- অটো গিয়ারের গাড়ি ম্যানুয়াল গিয়ারের গাড়ির চেয়ে কম শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। ফলে উচুস্থানে গাড়ি উঠতে হলে ম্যানুয়াল গাড়ির মতো ভরসা করা যায় না।
- ব্যাটারি বসে যাওয়া কিংবা অন্য কোন কারণে গাড়ি স্টার্ট না নিলে, অটো গিয়ারে গাড়ি থাক্কা দিয়ে স্টার্ট করা যায় না।
ম্যানুয়াল না অটোমেটিক গিয়ার: আপনার জন্য কোনটি ভাল?
তাহলে এতোক্ষণের আলোচনায় আমরা জেনে গেলাম। অটোমেটিক এবং ম্যানুয়াল গিয়ারের সুবিধা এবং অসুবিধা। এখন আপনার সিদ্ধান্ত আপনি কোনটিকে বেছে নিবেন। তবে দুটো গিয়ার সিস্টেমই সকলের জানা থাকা জরুরি। কেননা, যেকোনো মুহুর্তেই আপনার অটো কিংবা ম্যানুয়াল যেকোনো গাড়ি চালানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তাই আগে থেকেই দুটো গিয়ার সিস্টেমেই খুব ভালোভাবে আয়ত্ত্বে না থাকলে গাড়ি ড্রাইভ করা বিপদজনক হয়ে পড়তে পারে।
ম্যানুয়েল গিয়ার
যদি এমন হয় যে আপনি গাড়ি চালানো শিখবেন বলে পরিকল্পনা করছেন তবে আপনাকে অবশ্যই ম্যানুয়েল গিয়ারের গাড়ি দিয়ে গাড়ি চালানো শিখতে হবে। এক্ষেত্রে, আপনার প্রতি পরামর্শ থাকবে ম্যানুয়াল গিয়ারের পিকআপ ভ্যান গাড়ি দিয়ে ড্রাইভিং শিখতে, কেননা এমন ভারী যান দিয়ে যদি আপনি ড্রাইভিং শিখেন তবে প্রাইভেট কার চালানো আপনার জন্য অনেকবেশি সহজ হবে।
আমরা সকলেই জানি, আমরা সবসময় একই আকারের গাড়ি চালাবো না। দেশ কিংবা দেশের বাহিরে আমাদের হুটহাট বিভিন্ন মডেলের গাড়ি চালানোর প্রয়োজন পড়বে তখন আপনি যদি শুধুমাত্র ২.৫ ফিট বনেটের ছোট কার দিয়ে ড্রাইভিং শিখে থাকেন তবে বড় গাড়ি বা বনেট ছাড়া যেসকল কার রয়েছে সেগুলো চালাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবে। তাই আপনি নতুন গাড়ি চালনা শিখতে চান যদি, তবে খুব ভেবেচিন্তে গাড়ি নির্বাচন করবেন এবং চেষ্টা করবেন একটা নির্দিষ্ট গাড়ি দিয়ে ড্রাইভিং না শিখে ভিন্ন মডেলের গাড়িতে প্রেকটিস করতে তাহলে আপনাকে নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি চালাতে গিয়ে বেগ পোহাতে হবে না।
অটোমেটিক গিয়ার
বর্তমানে বহুল জনপ্রিয় গিয়ারসিস্টেম হচ্চে অটো গিয়ার তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে। আপনার যদি এমন হয় যে, আপনি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গাড়িই চালাবেন এবং আপনার নিজস্ব গাড়ি রয়েছে তবে আপনি শুধু অটো গিয়ারের গাড়ি দিয়ে গাড়ি চালানো শিখতে পারেন, তবে সেটা না করাই উত্তম হবে। কেননা, অটো গিয়ারে গাড়ি চালানো শিখলে গাড়ির গিয়ার কিভাবে ফাংশান করে সেটা শেখা যায় না। ফলে আপনি অটো গিয়ারে গাড়ি চালানো শিখে ম্যানুয়াল গাড়ি চালাতে পারবেন না, এটা শতভাগ নিশ্চিত। তাই যেহেতু শিখবেনই আপনাকে অবশ্যই প্রথমে ম্যানুয়াল দিয়ে শুরু করার পরামর্শ থাকবে।
তবে যদি এমন হয় আপনি মিডিয়াম কিংবা এক্সপার্ট কেউ একজন তবে এপর্যায়ে অটো গিয়ার আপনার জন্য ঠিক আছে। স্মুথ ড্রাইভিং এর জন্য অটো গিয়ারবক্স দারুণ জিনিস। তাই হিসাব একদম সহজ প্রথমে ম্যানুয়াল তারপর অটো গিয়ার। ব্যস!
উপসংহার
আমাদের সকলেই উচিত অটোমেটিক এবং ম্যানুয়েল দুটি গিয়ার সিস্টেমকেই খুব ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করা। আপনার যাত্রা শুভ হোক, নিরাপদ হোক রাস্তায় আপনার ড্রাইভিং। শুভ কামনা আপনার জন্য।