জীবন কখনো একবারও জ্যামে পড়েননি, এরকম মানুষ বোধহয় খুব বেশী নেই । জ্যামের ভয়াবহতায় সবচেয়ে বেশী যেই বাহনটি আমরা দেখি, তা হলো গাড়ি । যতদূর চোখ যায়, রাস্তায় শত শত গাড়ি ।
গাড়িতে চড়া হয়নি, এমন মানুষের সংখ্যাও কম । নিজের গাড়ি না হলেও ট্যাক্সির বদৌলতে হলেও গাড়িতে চড়া হয়েছে সবারই । কখনো সখনো প্রশ্ন এসেছে মাথায়, এতগুলো মানুষ বা ব্যাগপত্র মাল সামান সহ কিভাবে চলে গাড়ি ?
ইঞ্জিন কি?
গাড়ির মূল শক্তি তার ইঞ্জিন । আর, আজ আমরা সেই ইঞ্জিন সম্পর্কেই জানবো । আরো জানবো কিভাবে কাজ করে আমাদের বহুর পরিচিত গাড়িগুলোর ইঞ্জিন ।
ইঞ্জিন (Engine) শব্দটি এসেছে প্রাচীন ফরাসি “engin” এবং ল্যাটিন “ingenium” শব্দ থেকে । উনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে এবং ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লবের সময় উদ্ভাবিত অধিকাংশ যন্ত্রকেই ইঞ্জিন বলা হত । যে সকল যন্ত্র তাপশক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে সেসব যন্ত্রই ইঞ্জিন । তাপগতিবিজ্ঞান অনুসারে, যে যন্ত্র তাপ শক্তিকে কার্যকর যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে, তাকে তাপ ইঞ্জিন বলে, বা সংক্ষেপে ইঞ্জিন । এটি তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের ওপর কাজ করে নির্মিত । বর্তমানে ইঞ্জিন বলতে সচরাচর বাষ্পীয় ইঞ্জিন অথবা অন্তর্দহন ইঞ্জিনকে বোঝানো হয়ে থাকে যা জ্বালানী পুড়িয়ে যান্ত্রিক কাজ সম্পন্ন করে থাকে ।
আমরা জানি যে, শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তর করা যায় মাত্র । ইঞ্জিনের কর্মনীতি এই সূত্র মেনেই চলে । ইঞ্জিন স্বয়ংক্রিয় ভাবে জ্বালানি বা ফুয়েল দহন এর মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তিকে প্রথমে তাপশক্তিতে এবং তাপশক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে এবং তার ফলে কোন নির্দিষ্ট কাজ করতে পারে । গাড়ির ক্ষেত্রে এই কার্যকরী শক্তি গাড়িকে চলতে সাহায্য করে ।
প্রথম ইঞ্জিনের ইতিহাস
ইঞ্জিনের সাহায্যে আমরা গতি পাই । তাই বলে কি ইঞ্জিন আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ গতি তৈরি করতো না ? অবশ্যই করতো । তা ছিল নিজের পেশী শক্তি দিয়ে না হয় কোন প্রাণী দিয়ে, যা দিয়ে কাজ হতো কম কিন্ত পরিশ্রম হতো বেশী । গ্রামে গঞ্জে গরুর গাড়ি, পালকি বা সহুরে এলাকায় রিক্সা ভ্যান – ইত্যাদিকে আমরা উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি ।
১৭৭২ সালে ইংলিশ বিজ্ঞানী থমাস নিউকমেন বাষ্প চালিত পাম্প আবিষ্কার করেন যা খনি থেকে পানি তুলতে ব্যবহার করা হত । এরপরে থমাস নিউকমেন এর আবিষ্কৃত বাষ্প ইঞ্জিনকে আরো উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করেন জেমস ওয়াট । জ্বালানী দক্ষতার অভাবনীয় বৃদ্ধির কারণে তার ইঞ্জিনটি আরো ভালো কাজ করতে শুরু করে এবং শুরু হয় শিল্প বিপ্লব । তার কাজের পেছনে আরেকজন মানুষ যার কথা না বললেই নয়, তিনি হচ্ছেন জেমস ওয়াটের ব্যবসায়িক সঙ্গী ম্যাথু বোল্টন ।
ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে?
প্রথমেই আমরা জেনেছি যে, ইঞ্জিন থেকে আমরা গতি পাই । ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন ছিল প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিন । এই ইঞ্জিনে আংশিক বায়ুশূন্য স্থানে বায়ুমন্ডলীয় চাপের চেয়ে সামান্য অধিক চাপের বায়ু প্রবাহ চালনা করা হয় । বাষ্পের যে চাপ তৈরী হয় তার মাধ্যমে একটি পিস্টনকে ধাক্কা দেয়া হয় । পিস্টনটি যুক্ত থাকে একটি কানেকটিং রড এর সাহায্যে ক্র্যাংক শ্যাফটের সাথে । এভাবেই গতি পাওয়া যায়।
তাঁর এই উদ্ভাবনের ফলে সেমি-অটোমেটেড কারখানার দ্রুত উন্নতি হয়, যা জলশক্তি সংকটাপন্ন অঞ্চলে কল কারখানা স্থাপনকে সহজ করে । এবং এই ইঞ্জিনের উন্নতি সাধন করেই বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিন তৈরী করা হয়, যার মাধ্যমে রেল পরিবহন ব্যবস্থার প্রসার ঘটে ।
বাষ্প ইঞ্জিনে কয়লা দিয়ে পানিকে বাষ্প করা হত। এখানে একটি বিষয় ভালো ভাবে বোঝা দরকার, এবং তা হলো দহন বা Combustion । যে কোন জ্বালানীকে আগুনে পোড়ালে তাপ উৎপন্ন হয় । এই প্রক্রিয়াকে দহন বলে । দহন কোথায় হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে ইঞ্জিনকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ অন্তঃ দহন (Internal Combustion) ইঞ্জিন এবং বহিঃ দহন (External combustion) ইঞ্জিন অর্থাৎ দহন ইঞ্জিনের বাহিরে সম্পন্ন হয় । যেমনঃ বাষ্প ইঞ্জিন ।
কিন্ত এই বাষ্পীয় ইঞ্জিনের একটা বড় সমস্যা ছিলো যা হচ্ছে এখানে ইঞ্জিনের বাইরে দহন হতো । ভাবা যাক, আজকালকার যানবাহন মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক বা গাড়ি – এগুলোতে বহিঃদহন ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় । তাহলে বাসের পিছনে একটা বড় চুল্লি থাকত আর সেখানে কয়েকজন কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালাতো। বিশাল বড় একটা পানি গরম করার পাত্র থাকতে হত । তাহলে মানুষ, অন্য কোন প্রাণী বা ব্যাগপত্র নেওয়া হতো কি করে ?
আধুনিক ইঞ্জিনের ইতিহাস
এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে অন্তর্দহন ইঞ্জিন বা Internal Combustion ইঞ্জিন । এই ইঞ্জিনের মডেল যিনি প্রথম দিয়েছিলেন তার নাম নিকোলাস অটো ।
জার্মান এই নাগরিক ১৬ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছেড়ে প্রথমে মুদির দোকানে কাজ করেন তারপর ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা হিসাবে কাজ করেন । সেই কাজের জন্য তাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো এবং যাতায়াতের অসুবিধা থেকেই তিনি ভাবতে শুরু করেন এমন এক বাহনের কথা যা কিনা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাবে কিন্তু সময় নেবে কম ।
১৮৬২ সালে তিনি তার চিন্তার ওপর কিছু ডিজাইন করেন । তার হাত ধরেই পেট্রোলিয়াম গ্যাসের সাহায্যে চলা অন্তর্দহন ইঞ্জিনের উন্নয়ন ঘটে । এই ইঞ্জিনে মুলত গ্যাসোলিন বা পেট্রোল জাতীয় জ্বালানি ব্যবহার করা হতো । এরপরে ১৮৬০ সালে, ইতিয়েন লেনোর নামক এক বিজ্ঞানী প্রথম ব্যবসায়িকভাবে সফল একটি অন্তর্দহন ইঞ্জিন উদ্ভাবন করেন । ১৮৭৭ সালে এই ইঞ্জিন অটোচক্র বাষ্পীয় ইঞ্জিনের চেয়ে অধিক ক্ষমতা-ভরের অনুপাত দিতে সক্ষম হয় । এর ফলে, গাড়ি এবং উড়োজাহাজের মতো অনেক যাতায়াতের মাধ্যমে এই ইঞ্জিনটি অধিক কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং তা ব্যবহৃত হতে থাকে যানবাহনে ।
এই ক্ষেত্রে আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার এর কথা আমাদের বলতেই হবে যার নাম রুডলফ ডিজেল । ফ্রেঞ্চ এই বিজ্ঞানী ১৮৯২ সালে আবিষ্কার করেন তার নাম ডিজেল ইঞ্জিন । বাস, ট্রাক সহ বড় বড় যানবাহন যেগুলো যাতায়াতে অনেক বেশী ভার বহন করে এবং অনেক বেশী জ্বালানি নিতে হয় সেগুলোতে ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় ।
এছাড়াও, ১৮০৭ সালে ফ্রান্সে ডি রিভাজ এবং নীপচ ব্রাদার্স অন্তর্দহন পিস্টন ইঞ্জিন নিয়ে পৃথকভাবে পরীক্ষা চালান । বিজ্ঞানী কার্নো যার তাত্ত্বিক বিকাশ সাধন করেন ১৮২৪ সালে । ১৮৫৫৭ সালে ইউজেনিও বার্সান্তি ও ফিলিচে মাত্তেউচি মুক্ত-পিস্টন নীতি ব্যবহার করে একটি ইঞ্জিন উদ্ভাবন এবং সংরক্ষণ করেন যাকে পৃথিবীর প্রথম চতুর্ঘাত ইঞ্জিন বলা হয় ।
কার্ল বেঞ্জ নামক বিজ্ঞানী প্রথমবার হালকা মোটরগাড়ি অথচ এবং শক্তিশালী ইঞ্জিন তৈরী করেন । হালকা মোটরযান তৈরীতে চতুর্ঘাত অটোচক্রে পরিচালিত গ্যাসোলিন অন্তর্দহন ইঞ্জিন সফল হলেও ট্রাক ও বাসে অধিকতর দক্ষ ইঞ্জিন হিসেবে ডিজেল ইঞ্জিনই ব্যবহৃত হয় । বর্তমানে ছোট ছোট মোটর গাড়িতে টার্বো ডিজেল ইঞ্জিনও ব্যবহা রকরা হয় । ১৮৯৬ সালে কার্ল বেঞ্জকে অনুভূমিকভাবে বিপরীতমুখী পিস্টনচালিত ইঞ্জিনের নকশা তৈরীর জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
শুরুতে বাষ্প ইঞ্জিন দিয়ে চলত বাষ্প চালিত ট্রেন । ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাষ্প ইঞ্জিনের মাধ্যমের পরিবহন এবং কারখানার কাজের মাধ্যমে শিল্প বিপ্লব ঘটে । মানুষের জীবনে আসে গতি, উৎপাদন বেড়ে যায় বহুগুণ ।
বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর বিভিন্ন প্রচেষ্টা চলতে থাকে । মানুষ ভাবতে থাকে আরো উন্নত, আরো হাল্কা, কম জ্বালানীতে বেশী কাজ করার ইঞ্জিন । সেখান থেকেই আবিস্কৃত হয়েছে একের পর এক নিত্যনতুন ধরনের ইঞ্জিন ।
ইঞ্জিনের আবিস্কারের ফলে সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও কিন্ত নয় । ইঞ্জিন ডিজাইন, ইঞ্জিন জ্বালানী, ইঞ্জিনের তৈরি ধোঁয়া থেকে যে দূষণ ইত্যাদি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ ও প্রচুর কাজ হচ্ছে, গবেষণা চলছে । মানুষ চেষ্টা করে চলেছে আরো উন্নত ইঞ্জিন আবিস্কার করার যাতে করে এইসব সমস্যা দূর করে পৃথিবীকে আরো সুন্দর, আরো বাসযোগ্য করে তোলা যায় ।
বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতি এবং আমাদের উন্নতি সাধনের এই যজ্ঞে শামিল হতে হবে আমাদের সবার । তাহলেই গড়ে উঠবে এক অন্যরকম সুন্দর পৃথিবী ! মোটর গাড়ি আবিস্কারের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে এই ব্লগ পোস্টটি পড়ুন।
শখের গাড়ির সকল তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে এবং গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী ব্যবহার করতে পারেন। এটি একটি ভেহিক্যাল ট্র্যাকার সার্ভিস (VTS) ডিভাইস যা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে পাই ল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রহরী – ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং সিস্টেমে রয়েছে অ্যাপের মাধ্যমে ইঞ্জিন লক/আনলক করার সুবিধা, গাড়ির লাইভ ট্র্যাকিং আপডেট দেখা, এবং ট্রাভেল হিস্টোরি চেক করা সহ আরও অনেক সুবিধা বিস্তারিত জানতে দেখুন প্রহরী প্যাকেজ সমূহ।