প্রহরী

গাড়ি আবিস্কারের ইতিহাস
পড়তে লাগবে: 4 মিনিট

মোটর গাড়ি আবিস্কারের ইতিহাস!

বর্তমানে যেসব গাড়ি আমরা ব্যবহার করি তা কে এবং কখন আবিষ্কার করেছেন এই প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই। কারণ এটি এমন একটি কাজ যা গত কয়েকশ বছর ধরে চলছে এবং এর উন্নয়নে এখনও মানুষ কাজ করে যাচ্ছে । আর আজকের গাড়িও একদিন হুট করে আবিষ্কার করা হয়নি। বরং শত শত বছর ধরে নানান দেশের অসংখ্য গুণী মানুষের পরিশ্রমের ফসল আজকের আধুনিক গাড়ি। তারা বাষ্প, বিদ্যুত, পেট্রল, গ্যাস ইত্যাদি দিয়ে চালিত বিভিন্ন ধরণের বিভিন্ন নকশার গাড়ি উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন। আজকের আর্টিকেলে এই গাড়ি আবিস্কারের ইতিহাস জেনে নিই চলুন।

গাড়ি আবিষ্কারের ধারাবাহিক ইতিহাস

যেহেতু গাড়ি আবিষ্কার ও এর উন্নয়ন একবারে ঘটেনি তাই সেই ধারাবাহিকতা অনুসারে গাড়ি আবিষ্কারের ইতিকথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

১৪০০ – ১৮০০ সাল পর্যন্ত

গাড়ি নিয়ে চিন্তা করার অনেক বছর আগেই লিওনার্দো দা ভিঞ্চি স্ব-চালিত গাড়ির ডিজাইন করেছিলেন ১৪৭৮ সালে। কিন্ত তার এ গাড়িটি কাগজের স্কেচ হিসেবেই রয়ে গেছে এবং বাস্তবে কখনও তৈরি হয় নি। তার এই গাড়িটির স্কেচ আজকাল আমরা যেসব গাড়িতে চড়ি বা দেখি তার মতো ছিল না। এটি দেখতে অনেকটা শপিং কার্টের মতো এবং এতে আসন নেই। ২০০৪ সালে দা ভিঞ্চির গাড়ির একটি প্রতিরূপ অবশেষে তৈরি করা হয়। এটি ইতালির ফ্লোরেন্সের জাদুঘরে দেখা যাবে।

গাড়ি আবিষ্কারের সবচেয়ে প্রথম ও কার্যকর পদক্ষেপ ছিল ১৭৬৯ সালে ফ্রান্সের নিকোলাস-জোসেফ কুগনোটের প্রথম স্ব-চালিত সড়ক যান তৈরি । এই যানটি ছিল ট্রাক্টরের মত যা ফরাসি সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি হয় । এটির তিনটি চাকা ছিল এবং প্রতি ঘন্টায় প্রায় ২.৫ মাইল বেগে চলত।

এরপর ১৭৮৯ সালে আমেরিকান নাগরিক অলিভার ইভান্স বাষ্প চালিত একটি বিশেষ যানের জন্য প্রথম মার্কিন পেটেন্ট পান।১৮০৫ সালে তার নতুন ধরনের বাষ্প-ইঞ্জিন আত্মপ্রকাশ লাভ করে যা কৃষিখাতে খননের কাজে লাগানো যেত।

১৮০০ – ১৯০০ সাল পর্যন্ত

  • ১৮০১ সালে ইংল্যান্ডের উদ্ভাবক রিচার্ড ট্রেভিথিক একটি বাষ্প চালিত গাড়ি তৈরি করেন। এটিকে প্রথম ট্রামওয়ে লোকোমোটিভ বলে মনে করা হয়। কিন্তু এটি সড়কে ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল, রেলপথে নয়।
  • ১৮০৭ সালে সুইজারল্যান্ডের ফ্রাঙ্কোইস আইজ্যাক ডি রিভাজ একটি ইঞ্জিন উদ্ভাবন করেন যাতে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের মিশ্রণ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ইঞ্জিনের জন্য একটি গাড়িও ডিজাইন করেন যা ছিল Internal combustion engines বা অন্তর্দহন ইঞ্জিন দ্বারা চালিত প্রথম অটোমোবাইল। কিন্তু তার এ গাড়ি সফলতার মুখ দেখে নি।
  • ১৮২৩ সালে ইংরেজ প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবক স্যামুয়েল ব্রাউন একটি মোটর ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন যা অন্তর্দহন ইঞ্জিনের মাধ্যমে চলত। এটির পৃথক দহন ব্যবস্থা এবং কার্যকরী সিলিন্ডার গাড়িতে যান্ত্রিক শক্তির সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
  • ১৮৩২ সালে রবার্ট অ্যান্ডারসন স্কটল্যান্ডে প্রথম স্থূলাকার একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি আবিষ্কার করেন। এটি নন-রিচার্জেবল প্রাইমারি পাওয়ার সেল দ্বারা চালিত হয়।
  • ১৮৬৩ সালে বেলজিয়ান প্রকৌশলী জিন-জোসেফ-এটিন লেনোয়ার “ঘোড়াবিহীন গাড়ি” আবিষ্কার করেন। এটিও অন্তর্দহন ইঞ্জিন ব্যবহারে চলত এবং গতিবেগ ছিল প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৩ মাইল । আর এটিই ছিল প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল অন্তর্দহন ইঞ্জিন।
  • ১৮৬৭ সালে জার্মানির নিকোলাস অগাস্ট অটো অন্তর্দহন ইঞ্জিনের আরও উন্নতি করেন। এটিই ছিল প্রথম ইঞ্জিন যা দক্ষভাবে সরাসরি পিস্টন চেম্বারে জ্বালানী পোড়াতে সক্ষম হয়।
  • ১৮৭০ সালে ভিয়েনার জুলিয়াস হক গ্যাসোলিন চালিত প্রথম অন্তর্দহন ইঞ্জিন তৈরি করেন।
  • ১৮৭৭ সালে জার্মানির নিকোলাস অগাস্ট অটো পরবর্তীতে চার-চক্রের অন্তর্দহন ইঞ্জিন তৈরি করেন, যা আধুনিক গাড়ির ইঞ্জিনগুলির প্রোটোটাইপ। তার এ আবিষ্কার গাড়ির জগতে নতুন যুগের সূচনা করে।
  • ১৮৭৯ সালে আমেরিকান উদ্ভাবক জর্জ বাল্ডউইন একটি অটোমোবাইলের জন্য প্রথম মার্কিন পেটেন্ট ফাইল করেন। এই আবিষ্কারটি ছিল অন্তর্দহন ইঞ্জিনচালিত একটি ওয়াগনের মতো।
  • ১৮৮৫ সালে জার্মান ইঞ্জিন ডিজাইনার কার্ল বেঞ্জ পেট্রল ইঞ্জিন বা গ্যাসোলিন চালিত প্রথম সত্যিকারের অটোমোবাইল তৈরি করেন। এটার তিনটি চাকা ছিল এবং দেখতেও এখনকার গাড়ির মতোই ছিল।
  • ১৮৮৬ সালে মিশিগানে হেনরি ফোর্ড তার প্রথম অটোমোবাইল তৈরি করেন।
  • ১৮৮৬ সালে গটলিব উইলহেম ডেমলার এবং উইলহেম মেবাচ জার্মানিতে প্রথম চার চাকার, চার-স্ট্রোক ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন। এটি “ক্যানস্ট্যাট-ডেমলার” নামে পরিচিতি পায়।
  • ১৮৭৬ সালে আমেরিকান নাগরিক জর্জ বাল্ডউইন সেলডেন ক্যারেজযুক্ত একটি অন্তর্দহন ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন। কিন্ত এটি কখনই তৈরি হয় নি।
  • ১৮৯৩ সালে ফ্র্যাঙ্ক এবং চার্লস এডগার ডুরিয়া ভ্রাতৃদ্বয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সফল গ্যাস চালিত গাড়ি আবিষ্কার করেন।
  • ১৮৯৬ সালে ডুরিয়া ভ্রাতৃদ্বয় ম্যাসাচুসেটসের স্প্রিংফিল্ডে প্রথম আমেরিকান গাড়ি উৎপাদন শুরু করে। একে মোটর ওয়াগন বলা হয়।
  • ১৯০০ সালে স্টিয়ারিং টিলারের বদলে স্টিয়ারিং হুইল ডিজাইন করা হয়।

১৯০১ – ২০০০ সাল পর্যন্ত

  • ১৯১৩ সালে আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার হেনরি ফোর্ড মডেল টি নামের গাড়ি উৎপাদন করেন। তার এ গাড়ি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়।এতে করে তার গাড়ির বিক্রিও বৃদ্ধি পায়। এর কারণ গাড়ি নির্মানে তিনি এসেম্বলি লাইনের ব্যবহার করেছিলেন।
  • ১৯২৪ সালে গাড়িতে রেডিও চালু হয়।
  • ১৯৪০ সালে বিশ্বের প্রথম ফোর-হুইল ড্রাইভ সম্বলিত গাড়ি আবিষ্কৃত হয় যা মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। এটি জিপ নামে পরিচিতি পায়।
  • ১৯৩২-১৯৪২ সালের দিকে জার্মান স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলার হেনরি ফোর্ডের গাড়ি মডেল-টি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জার্মান অটোমোবাইল-নির্মাতা ডক্টর ফার্ডিনার্ড পোর্শেকে কম খরচে গাড়ি নির্মাণের নির্দেশ দেন।এরপর ফার্ডিনার্ড পোর্শে “ভোক্স ওয়াগেন” কেডিএফ (ক্রাফ্ট ডার্চ ফ্রয়েড বা স্ট্রেংথ থ্রু জয়) তৈরি করেন। যার নামকরণ করা হয়েছে বিটল।
  • ১৯৬২ সালে উইসকনসিনে সিট বেল্ট আইন চালু হয় । গাড়ির ক্ষেত্রে সিটবেল্টকে একটি আদর্শ প্রয়োজন বলে দাবি করা হয়।
  • ১৯৭৪ সালে গাড়ির নিরাপত্তায় এয়ার ব্যাগ ব্যবহার শুরু হয়।
  • ১৯৯৫ সালে গাড়িতে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা GPS চালু করা হয়।
  • ১৯৯৬ – গ্যাসোলিনের ক্রমবর্ধমান খরচ এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে বৈদ্যুতিক যানবাহন তৈরির প্রতি নজর দেওয়া হয়।
  • ১৯৯৭ – প্রথম হাইব্রিড ইলেকট্রিক গাড়ি টয়োটা প্রিয়স জাপানে তৈরি ও বিক্রি হয়।
  • ২০০০ এর দশকের শেষের দিকে – পরিবেশগত উদ্বেগ এবং মন্দার কারণে অনেক যানবাহন নির্মাতারা আরও দক্ষ যানবাহনের জন্য জনপ্রিয় গ্যাসোলিন গাড়ি ত্যাগ করতে শুরু করে।

এছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পেট্রোলের উচ্চ দাম, ব্যাটারি প্রযুক্তির উন্নতি এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বৈদ্যুতিক গাড়িগুলির প্রতি নতুন করে আগ্রহ বেড়েছে।আর বৈদ্যুতিক গাড়ি পরিবেশ বান্ধব এবং দামেও সস্তা বলে মনে করা হয়। এখন ২০২২ সালে যেন সর্বাধুনিক উপায়ে গাড়ি তৈরি হচ্ছে। গাড়ি আবিষ্কারের ইতিকথা থেকে বোঝা যায় বর্তমানে এ সর্বাধুনিক গাড়ি ব্যবহার করতে পারছি অতীতের গাড়ির বিভিন্ন বিবর্তনের জন্যই।

বাষ্পীয় যুগে গাড়ি

ফ্রান্সের নিকোলাস-জোসেফ নট এমন এক ব্যক্তি যাকে সবাই স্মরণ রাখবে বাষ্পীয় গাড়ির যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়নের কারণে। তাঁর হাত ধরেই সত্যিকারের একটি মোটর গাড়ি আবিষ্কৃত হয় যা কি না ছিল বাষ্পচালিত। এটির গতি ছিল প্রায় ৩.৬ কিলোমিটার। তবে এটির বড় সমস্যা ছিল এটি বেশ ধীর গতির ছিলো। ৪ জন মানুষকে নিয়ে এটি ২০ মিনিট টানা পথ পাড়ি দিতে পারতো। কিন্তু এর পরেই এটি ২০ মিনিটের জন্য থেমে যেত। রাস্তায় চলাচলের জন্য এটি বেশ বেকায়দায় ফেলার মতো একটি বাহন ছিলো। ফলে এটির প্রচলন বেশি দিন ধরে দেখা যায়নি।

ব্যাটারিচালিত গাড়ি

আমাদের সকলেরই জানা ১৮৬০ সালে গ্ল্যাস্টন প্ল্যান্ট স্টোরেজ ব্যাটারি আবিষ্কার করেন। আবার ১৯৮১ সালে ক্যামেলিয়া ফরের হাত ধরে ব্যাটারি চালিত গাড়ি তৈরীর পথ সুগম হয়। ধীরে ধীরে এই গাড়িগুলো জনপ্রিয়তা পায়। রক্ষণাবেক্ষণের কম খরচ এবং শ্রমের কারণে এগুলো ১৮৮১ সালে ফ্রান্সের রাস্তায় দেখা যায়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এই গাড়িগুলো ১৮৮১ সালে শুরুতে ধীরে ধীরে আমেরিকার ও ব্রিটেনের রাস্তায় চলাচল করা শুরু করে।

গ্যাসলিন চালিত গাড়ি

গাড়ির আবিষ্কারের আরেক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে গ্যাসলিন চালিত গাড়ি। কোলাস অগাস্ট অটো, যাকে আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে প্রতিনিয়ত। আধুনিক গাড়ির ইঞ্জিনের মৌলিক কাঠামো তাঁর হাত ধরেই বেড়ে উঠে। তিনি সর্ব প্রথম চতুর্ঘাত বিশিষ্ট ইঞ্জিন তৈরী করেন। তাঁর এই গ্যাসলিন ইঞ্জিনে চারটি ধাপের জ্বালানী পুড়িয়ে শক্তি উৎপন্ন করা যায়। এই শক্তি থেকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আধুনিক গাড়িগুলোতে তাঁর গ্যাসলিন চালিত গাড়ির অনেক ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

শেষকথা

সময়ের আবর্তনে ধীরে ধীরে আসে নতুন প্রযুক্তির। সেই সাথে বদলায় আমাদের প্রিয় গাড়িগুলোর কাঠামো কিংবা অভ্যন্তরীণ বিষয় সামগ্রী। গাড়ি প্রেমিকদের জন্য এই ব্যাপারগুলো বরাবরই কৌতূহলের বিষয়। তবে এটা সত্যি গাড়ি যেকোন দশক কিংবা স্টাইলেরই হোক না কেন তা সব সময় আপন হয়ে থাকে তাঁর প্রিয় মনিবের কাছে।

    গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী সম্পর্কে জানতে

    Share your vote!


    এই লেখা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
    • Fascinated
    • Happy
    • Sad
    • Angry
    • Bored
    • Afraid

    মন্তব্যসমূহ

    Scroll to Top