আদর্শ জাতি হিসেবে জাপানিজরা খুব বেশী পরিচিত। যেকোন কিছু তৈরি করায় একেবারে নিখুঁত আর সেরা পণ্য তৈরিতে জাপানিদের জুড়ি নেই , বিশেষ করে গাড়ি। গাড়ির পার্টস থেকে শুরু করে সবকিছু তারা খুব বেশী যত্ন করে তৈরি করে। জাপানে প্রায় প্রত্যেকবছর বিপুল পরিমান গাড়ি তৈরি করা হয়। বেশীরভাগ জাপানি নাগরিক একটি গাড়ি দু-এক বছর ব্যবহারের পর আর ব্যবহার করতে চান না। নতুন গাড়ি কেনেন। ফলে বছর শেষে জাপানে অসংখ্য গাড়ি জমে। তখন জাপান সরকার এসব গাড়ি নিলামের জন্য নিলামের ঘরে নিয়ে যায়। আর এই অব্যবহৃত গাড়িগুলোকে কিছু রিপেয়ার করে বাজারে ছাড়াকে রিকন্ডিশন গাড়ি বলে। জাপানের ব্যবহৃত যেসব গাড়ি অন্যান্য দেশে বিক্রি করা হয় সেসব গাড়ি অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য আর নির্ভরযোগ্য হয়। কারণ জাপানিদের গাড়ি খুব একটা পুরাতন বা নষ্ট হয়না। গাড়িগুলো অন্য দেশে বিক্রির পরও আর ১০/১৫ বছর আনায়াসে চালানো যেতে পারে।
অকশন শিট
রিকন্ডিশন গাড়ি ছবিসহ সব খুঁটিনাটি সবকিছু একটি কাগজের মধ্যে লিখে একসাথে অকশন হাউসে রাখা হয়। যাতে যে কেউ কাগজগুলো পড়ে গাড়ি সম্পর্কে চটজলদি একটি স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারেন। কারণ গাড়িগুলো যখন নিলামে ওঠানো হয় তখন সময় অনেক কম থাকে। গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশী হওয়ায় একটি গাড়ি দেখতে ২/৩ মিনিটের বেশী সময় পাওয়া যায়না। কিন্তু তারা যে অকশন শিটটি বানায় সেই শিট দেখে যে কেউ গাড়ি কিনে ফেলতে পারেন । কারণ অকশন শিটটি হুবহু গাড়ির নির্ভুল বর্ণনা দিয়ে লেখা হয়।
অকশন শিটের প্রয়োজনীয়তা
অকশন শিট নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন অকশন শিট দেখব? অকশন শিটে একটি গাড়ির সবকিছুর বিশদ বর্ণনা দেয়া থাকে যেগুলো দেখে আপনি গাড়িটি কিনতে পারবেন । অকশন শিট দেখলে আপনার রিকন্ডিশন গাড়ি চোখে দেখারও প্রয়োজন পড়বে না। অকশন শিটে গাড়ির মাইলেজের উপর ভিত্তি করে গাড়ির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। যেমন- একটি গাড়ি যদি ৫০,০০০ কিমি চলে তাহলে সেটার দাম বেশী হবে আর তুলনায় ১০,০০০ কিমি মাইলেজের গাড়ির দাম কম হবে। সেটা তো গেল জাপানে কথা কিন্তু যখন আমরা বাংলাদেশের কথা বলব তখন অবশ্যই বলবো যে, বাংলাদেশে অকশন শিটগুলো দেখার সময় অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে নেবেন। তাহলে হয়তো ঠকে যাবার ভ্য় থাকবেনা ।
রিকন্ডিশন গাড়ি গ্রেডের ব্যাখ্যা
সাধারণত অকশন শিটে গাড়ির গ্রেডিং তিনটি ব্যাপারের উপর ভিত্তি করে করা হয়। প্রথমত এক্সটেরিওর, দ্বিতীয়ত ইন্টেরিওর এবং তৃতীয়ত মাইলেজ ।
এক্সটেরিওর গ্রেড পদ্ধতি
গাড়ির ডেন্ট, ঘষা খাওয়া বা অন্য কোন সমস্যা A,B,C,D দিয়ে বোঝানো হয়। যথাক্রমে A,B,C,D দিয়ে গাড়ির অল্প সমস্যা থেকে বেশী সমস্যা নির্দেশ করে।
গ্রেড A -এক্সটেরিওর একদম নতুনের মত দেখতে হলে হবে A ।
গ্রেড B -একটু দাগ তবে খুব সহজেই তোলা যাবে এমন হলে হবে B ।
গ্রেড C – যদি গাড়ির এক্সটেরিওরের অবস্থা মোটামোটি ভালো থাকে কিন্তু অল্প কোন পোড়া দাগ থাকে তাহলে সেটা হবে C গ্রেড।
গ্রেড D – সবশেষে D গ্রেড নিয়ে বোঝানো হয় যে এক্সটেরিওরের অবস্থা খুবই খারাপ।
গ্রেড S – গ্রেড S দিয়ে একটি ঝকঝকে নতুনে মত গাড়ি বোঝানো হয়। এই S গ্রেডের গাড়ি দেখলে মনে হবে একেবারে নতুন। বাংলাদেশে মূলত S গ্রেডের গাড়ি ব্র্যান্ড নিউ কার বলে বিক্রি করা হয়ে থাকে। এছাড়া আরো কিছু অক্ষর দ্বারা এক্সটেরিওর গ্রেড নির্ধারণ করা হয় –
A- গাড়ির উপরের অংশে কোন দাগ
U – গাড়িতে কোন প্রকার গর্ত থাকলে
B – দাগের সাথে কিছু গর্ত দেখা গেলে
W–গাড়িতে হালকা কাজ করানো হয়েছে এমন
S -জং ধরা ( কমলা রং দেখা যায় এমন)
C -জারা ( জং বেড়ে ভেতরের ধাতুর অংশ দেখা যায় এমন)
P -রংয়ের দাগ
H- রং উঠে যাওয়া
XX – প্যানেল প্রতিস্থাপন করা
X – কোন পার্টসের প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন
G -গ্লাসে পাথর টুকরা
Y- ফাটা কোন কিছু দেখা গেলে
E- টোল খাওয়া
ইন্টেরিওর গ্রেডিং পদ্ধতি
গ্রেড A – এই গ্রেডে বোঝানো হয় গাড়ির ভেতরে কোন পার্টস খোয়া যায়নি । সব পার্টস মজুত রয়েছে।
গ্রেড B – এই গ্রেডের গাড়িগুলো মোটামোটি ভালো। কোন রং,ডেন্ট বা মেরামতের প্রয়োজন পড়বে না ।
গ্রেড C –অল্প কিছু মেরামতের প্রয়োজন পড়তে পারে। যেমন- সিগারেটের পোড়া দাগ, খাবারের দাগ ,স্ক্রুর কোন গর্ত ইত্যাদি থাকতে পারে।
গ্রেড D – এই গ্রেডের গাড়িগুলো মোটামোটি খারাপ হয়। দাগ,পোড়া দাগ অথবা অন্য দাগ লক্ষ্য করা যায়।
গ্রেড E – খুবই খারাপ অবস্থার কোন গাড়িকে গ্রেড E তে ফেলা হয়। ড্যাশ বোর্ড ভাঙ্গা, সীটগুলো জীর্ণ এবং অনেক মেরামতের প্রয়োজন হতে পারে।
মাইলেজ গ্রেড পদ্ধতি
গ্রেড 7, 8, 9 অথবা S- এই গ্রেড দেওয়া হয় এমন গাড়িগুলোকে যেগুলো নতুন এবং নিলামে শুধুমাত্র ডেলিভারি মাইলেজে বিক্রি করা হয়।
গ্রেড 6- নতুন গাড়ির জন্য এই গ্রেড দেওয়া হয় কিন্তু ডেলিভারি মাইলেজ আরেকটু বেশী হয়। মাইলেজ সর্বোচ্চ ৩০০০০ কিমি পর্যন্ত হয়। কোন ধরনের দাগ থাকলে গ্রেড 6 দেওয়া হয়না। অর্থাৎ আপনি খালি চোখে দেখে বুঝতেই পারবেন না যে গাড়িটি পুরানো না নতুন।
গ্রেড 5- এমন গাড়িতে এই গ্রেড দেওয়া হয় যেগুলো মাইলেজ সর্বোচ্চ ৫০০০০ কিমি হয় । দুই একটা আচরের দাগ থাকতে পারে। নিশ্চিন্তে ৫ বছর চালাতে পারবেন ।
গ্রেড 4.5- গাড়ির অবস্থা চমৎকার কিন্তু মাইলেজ ১ লাখের উপর
গ্রেড 4- গাড়ির অবস্থা বেশ ভালো এবং বেশ নির্ভরযোগ্য। কিন্তু মাইলেজ কোন সমস্যা না (বেশিও হতে পারে কমও হতে পারে)। ফিল্ড টেস্টে অভিজ্ঞদের চোখে পাশ করা গাড়িগুলো ফেলা হয় এই গ্রেডে।
গ্রেড 3.5- অনেকটা গ্রেড 4 এর মতন গাড়িতে করা হয় কিন্তু রং আর প্যানেলে কিছু কাজ করার দরকার পড়তে পারে।
গ্রেড 3- জরুরী ভিত্তিতে রং আর প্যানেলের কাজ করাতে হবে অথবা প্যানেল জরুরী ভিত্তিতে পাল্টাতে হবে। শর্ত আর মেয়াদ অনুযায়ী গ্রেড 3 এর মতই কিন্তু মাইলেজ অনেক বেশী থাকে।
গ্রেড 2- খারাপ অবস্থার গাড়িগুলো 2 গ্রেডে ফেলা হয়। এই গ্রেডে গাড়ির শোচনীয় অবস্থা বোঝানো হয় । গর্ত, ক্ষয় ইত্যাদি গুরুতর সমস্যা নির্দেশ করে এই গ্রেডে। আপনি যদি ক্লাসিক বা বাস , ট্রাক জাতীয় গাড়ি খোজেন তাহলে এই গ্রেড থেকেই নির্বাচন করতে পারেন।
গ্রেড 1-দুই রকম হতে পারে-
১। ইঞ্জিনের মডিফিকেশন
২।অটো থেকে ম্যানুয়াল ট্রান্সমিশন পরিবর্তন
গ্রেড 0, A, R, RA – এই গাড়িগুলো পূর্বে মেরামতের ইতিহাস থাকে। নিলামে গাড়ির ভেতরের প্যানেল ঠিক করার কথা উল্লেখ থাকবে। এই মেরামত কম হতে পারে আবার বেশিও হতে পারে।
বাংলাদেশে যত জাপানিজ গাড়ি আসে এর মধ্যে প্রায় ৫০% হয় রিকন্ডিশন গাড়ি না হয় সস্তা পুরানো। দুঃখজনক হলেও এটাই সতি ! আমাদের আজকের এই লেখাটিতে আমরা এমন কিছু তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছি যাতে রিকন্ডিশন গাড়ি কিনতে যেয়ে কেউ ঠকে না যায় । গাড়ি তো মানুষ প্রত্যেক বছর কেনে না। আমাদের চেষ্টা হচ্ছে , আপনার শখের গাড়িটি কিনে আর চালিয়ে যেন আপনি মনের মধ্যে সন্তুষ্টি পান। শখের গাড়িটি কিনুন গাড়ির অবস্থা বুঝে ও সঠিক মূল্যে।