১
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ইতিহাস বারবার ফিরে আসে। শিল্প সংস্কৃতি তো বটেই এমনকি বাণিজ্যিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির উদাহরণও আছে। বর্তমান সময়ে ইলেক্ট্রিক গাড়ির জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই ইলেকট্রিক গাড়ি এবং ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়, বরং শত বছরের পুরোনো।
বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে, অর্থাৎ ১৯০০ সালে আমেরিকাতে মোট গাড়ি উৎপাদন হয়েছিল ৪১৯২টি। এর মধ্যে ১৬৮১টি ছিল স্টিম চালিত, ১৫৭৫টি ছিল ইলেকট্রিক কার আর গ্যাসোলিন চালিত গাড়ি ছিল মাত্র ৯৩৬টি। স্টিম চালিত গাড়ি সেইসময়ে তৈরি হলেও বাস্তবতার খাতিরে হারিয়ে গেছে। কিন্তু ফিরে এসেছে ইলেকট্রিক গাড়ি!
১৯০০ সালে নিউ ইয়র্কের প্রথম অটোমোবাইল শো’র পৃষ্ঠপোষকরা প্রায় সবাই বলেছিলেন, ইলেকট্রিক গাড়িই হতে যাচ্ছে গাড়ি বিশ্বের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সে সময়ে ইলেকট্রিক গাড়ির চল ১০ দশ বছরের বেশি টেকেনি। কিন্তু ইলেকট্রিক গাড়ির ভবিষ্যৎ বীজ কিন্তু তখনি বপন করা হয়ে গিয়েছিল।
১৯১১ সালে চার্লস ক্যাটারিং সর্বপ্রথম সেলফ-স্টার্টার গাড়ি তৈরি করেছিলেন। সেটা আদতে একটি ইলেকট্রিক গাড়িই ছিলো। এই গাড়ির অভ্যন্তরীণ-জ্বালানি নির্ভর ইঞ্জিন সেই সময়ে ততটা নির্ভরযোগ্য না হলেও, দিনকে দিন সেটি আরো উন্নত এবং সুসংগঠিত হতে শুরু করেছিল। আর সেই মুহূর্তেই ইলেকট্রিক গাড়ির উত্থান কিছুটা থিতু হয়ে গিয়েছিল। ১৮৯২ সালের মধ্যে ব্যাটারি নিয়ে গবেষণার কাজ থেমে গিয়েছিল এবং বর্তমান আধুনিক যুগের আগ পর্যন্ত এক প্রকার বন্ধই ছিল।
উৎপাদনের দিক দিয়ে ১৯০০ সালে ইলেকট্রিক গাড়ি ৩য় অবস্থানে থাকলেও, বর্তমানে এতটা ভাল অবস্থানে আসতে পারেনি। তবে চীনে ইলেকট্রিক গাড়ির জয়জয়কার ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। গত বছর শুধুমাত্র চীনেই প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ইলেকট্রিক গাড়ি রেজিস্টার হয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকাতে হয়েছে মাত্র দেড় লক্ষ। মনে করা হচ্ছে, এই বছরে চীনে ইলেকট্রিক গাড়ির উৎপাদন দিগুণ হয়ে যাবে।
২
বর্তমানে গাড়ি পৃষ্ঠপোষক এবং নির্মাতারা মনে করছেন, আগামীতে গাড়ির বিশ্বে সেলফ ড্রাইভিং কার রাজত্ব করতে যাচ্ছে। তাই যদি হয়, তাহলে সেই রাজত্বের ভার ইলেকট্রিক গাড়ির উপরেও এসে পড়বে। কারণ সেলফ ড্রাইভিং গাড়িটি যদি ইলেকট্রিক গাড়ি হয়ে থাকে তাহলে তার কার্যকারিতা সবচাইতে বেশি উপলব্ধ হবে। কারণ, ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি প্লাটফর্ম এবং অটোমেটিক টেকনোলোজির সমন্বয় করতে সবচাইতে সুবিধা পাওয়া যাবে ইলেকট্রিক গাড়ির ক্ষেত্রে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ, ইন্টারনাল জ্বালানি সমন্বিত বর্তমান গাড়িগুলো অনেকাংশেই ইলেকট্রিক গাড়ি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাবে। ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর মানুষ যখন ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে, ইঞ্জিন চালিত গাড়িতে ঝুঁকে গিয়েছিল, তেমনিভাবে ভবিষ্যতে মানুষ ইলেকট্রিক গাড়ির উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে যাবে।
বর্তমানে হাইব্রিড গাড়ির চাহিদাও বেড়েছে। আপনার কি মনেহয় এই হাইব্রিড গাড়ি সাম্প্রতিক সময়ের আবিষ্কার? না, একদমই না। ফার্ডিনান্ড পোর্শে প্রথম হাইব্রিড গাড়ি তৈরি করেছিল ১৯০০-১৯০২ সালের মধ্যে। এই গাড়ির গ্যাস ইঞ্জিন, গাড়ির চাকায় থাকা মোটরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতো।
ইতিহাসের প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরি করেছিলেন উইলিয়াম মরিসন। ১৮৯০ সালে তৈরি এই গাড়িটি গাড়ির ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এই গাড়িতেই ক্যারিজ টাইপ চাকার বদলে টায়ার চাকা ব্যবহার করা হয়েছিল। আর বৈদ্যুতিক ইস্টিয়ারিং এর কথা বলতে গেলে, প্রথম বৈদ্যুতিক ইস্টারিং এর আবিষ্কার হয়েছিল ১৮৯৭ সালে।
বর্তমানে যেসব ইলেকট্রিক গাড়ি দেখ যায় , তাতে রিজেনারেটিভ ব্রেকিং সিস্টেম রয়েছে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে তাপ হারিয়ে যাওয়া শক্তিকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু লুই এন্টনি কর্তৃক উৎপাদিত ইলেকট্রিক গাড়িতেও রেজেন ব্রেকিং সিস্টেম ছিল। তারপর নিউ ইয়র্কে শুরু হয় ইলেকট্রিক ট্যাক্সি ক্যাবের প্রচলন। ১৮৯৯ সালের দিকে নিউ ইয়র্ক শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ ট্যাক্সি ছিল বিদ্যুৎ চালিত। তখন ব্যাটারি চার্জিং এর জন্য স্টেশনও ছিল, যা কিনা বর্তমান সময়ে ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য একটু দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।
৩
গাড়ি নির্মাতারা বলে থাকেন, ইলেকট্রিক মোটর শুন্য আরপিএম-এ প্রায় শতভাগ টর্ক উৎপন্ন করতে সক্ষম। কিন্তু এই তথ্য তাদের কাছে একদমই নতুন নয়। ১৮৯৫ সালে যখন ইলেকট্রিক গাড়ি সর্বপ্রথম কোন গাড়ি রেস জিতেছিল, তখন থেকেই এই সত্য তাদের সামনে উন্মোচন হয়েছিল। আর ইতিহাসের প্রথম যেই গাড়িটি গতির সূচকে ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটারের সীমা অতিক্রম করেছিল, সেটিও একটি বেলজিয়ান ইলেকট্রিক গাড়ি! চালক ক্যামিলি জিনাতজি গাড়িটির সর্বোচ্চ অতিবেগ তুলেছিলেন ঘন্টায় ১০৪ কিলোমিটার।
এর থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে আমেরিকাতে ১৯০২ সালে বেকার টর্পেডো গাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। তুলনামূলক হালকা বডি এবং চেসিসের এই গাড়িটি অফিশিয়াল টেস্টে ঘন্টায় ১২৮.৭৪ কিলোমিটার গতি তুলেছিল, আর আন-অফিশিয়ালভাবে এর গতি ছিল ঘন্টায় ১৯৩ কিলোমিটার। এবার একজন কলেজ ড্রপ আউটের গল্প শোনা যাক। ১৮৮৪ সালে এই কলেজ ড্রপ আউট তার বাসার বেজমেন্টে তার প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরি করেছিলেন।
১৮৯৬ সালে আমেরিকার প্রথম গাড়ির ডিলারশিপ স্থাপিত হয়েছিল, যেখানে শুধুমাত্র ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রয় করা হত। এটা মাথায় রাখা ভাল যে, বর্তমানে সবচাইতে বিখ্যাত ইলেকট্রিক গাড়ি কোম্পানি টেসলা ডিলারশিপ নেটওয়ার্ক স্থাপনে কিছুটা বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
৪
১৯২০ সালের পরে ইলেকট্রিক গাড়ির বাজারে যেই মন্দা শুরু হয়েছিল তা যদি না হতো তাহলে আরো কয়েক দশক আগেই আমরা লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সুবিধা ভোগ করতে পারতাম। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, ১৯৬০ সালের পর যখন ইলেকট্রিক গাড়ির বাজার পুনরুজ্জীবিত হতে শুরু করেছিল, তখনও এর ক্ষমতার উৎস ছিল লেড এসিডের ব্যাটারি। কিন্তু সেই ব্যাটারিও বাজারে সুবিধা করতে পারেনি কারণ তখন প্রতি গ্যালন গ্যাসের দাম ছিল মাত্র ৩০ সেন্ট।
ভবিষ্যতকে আরো ভালোভাবে তৈরি করার জন্য আমরা আমাদের উজ্জ্বল অতীত ইতিহাসকেই খুঁড়ে দেখি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যা করেছিল, তাই আমাদের আগামীতে পথ চলার পাথেয় হয়ে ওঠে। শুধু গাড়িই নয়, প্রযুক্তির বেলায় ও একই শর্ত খাটে। ইলেকট্রিক গাড়ি এখন সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর, তার সাথে গাড়ির সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার জন্যও আবিষ্কার হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। গাড়ি ট্র্যাকিং এর জন্য প্রথম জিপিএস ব্যবহার করা হয়েছিল আজ থেকে আরো প্রায় কয়েক দশক আগে যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু সেই ইতিহাস আবারো ফিরে এসেছে ভেইকেল ট্র্যাকার হিসেবে। আগে এই প্রযুক্তি শুধুমাত্র গাড়ি ট্র্যাক করার জন্য ব্যাবহার করা হলেও বর্তমানে গাড়ির সমস্ত খবরা খবর যেমন- ফুয়েল মনিটরিং, ডোর লক এলার্ট, ইঞ্জিন লক আনলক, স্পিড ভায়োলেশন সহ আরও অনেক ফিচারই রয়েছে বর্তমান ভেইকেল ট্র্যাকারগুলোতে। গাড়িতে ভেইকেল ট্র্যাকার থাকলে একজন গাড়ির মালিক অনেক খানিই টেনশন মুক্ত থাকেন। এখন আর বিদেশে নয়, বাংলাদেশেই তৈরি হচ্ছে ভেইকেল ট্র্যাকার প্রহরী।