মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্ব লড়াইয়ের গল্পগাঁথা, আমাদের গর্বের জায়গা! লাখো প্রাণের বিসর্জিত রিক্ত বেদনার হাত ধরেই এসেছে এ বিজয়! সবুজ শ্যামলিমার বুক চিরে শহীদের তাজা লাল রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই লাল-সবুজের স্বাধীনতা! বাংলার দামাল সন্তানেরা অসীম সাহস আর প্রবল মনোবলের সাথে গুঁড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি শকুনদের আস্ফালন। ঢাকায় পাকসেনাদের নিত্য নতুন কৌশলে বার বার আঘাত হেনে যে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ভিত নড়বড়ে করে তুলেছিল সেই দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীর নাম “ক্র্যাক প্লাটুন”। তৎকালীন ঢাকাবাসী তাদের সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘বিচ্ছু বাহিনী’। ১৯৭১ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ক্র্যাক প্লাটুন ছিল পাক আর্মির কাছে এক ঝড়ো আতংকের নাম! যারা ত্রাস সৃষ্টি করে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল শত্রুসেনাদের মনোবল। আসুন আজকের আয়োজনে এই ক্র্যাক প্লাটুন বা বিচ্ছু বাহিনী সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিই।
ক্র্যাক প্লাটুন
ক্র্যাক প্লাটুন মানে হার না মানা অদম্য গেরিলা যোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার গল্প! অনেক জন সাহসী তরুণ সদস্য নিয়েই গঠিত হয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুন। তবে প্রাথমিকভাবে গঠিত দলের ১৭ জন সদস্য ঢাকায় অপারেশনের জন্য আসেন। ক্রমান্বয়ে ক্র্যাক প্লাটুন দলের সদস্য সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। তবে তাদের মাঝে অন্যতম সদস্য ছিলেন শহীদ শফি ইমাম রুমী, শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, শহীদ বদিউল আলম বদি, শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, শহীদ মোহাম্মদ আবু বকর, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, আহমেদ মুনীর ভাষণ, আজম খান, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, লিনু বিল্লাহ এবং আরও অনেকেই! এই ক্র্যাক বয়েজ’রা মুক্তির প্রশ্নে হিমালয়ের মতো অবিচল এবং দৃঢ়চেতা ছিলেন। বাঘের ন্যায় প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় তারা ঢাকায় পাক আর্মিদের শক্ত ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়ে নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন তাদের ভিত। এরা ভীষণ সাহসিকতা এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে “হিট এন্ড রান” পদ্ধতিতে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে পাক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার করেছিল!
যেভাবে গঠিত হলো ক্র্যাক প্লাটুন
১৯৭১ সালের উত্তাল সময়! চারদিকে শত্রু বাহিনীর ভয়াল তাণ্ডব। দেশ মাতৃকার সম্মান রক্ষার্থে গঠিত হয়েছে মুক্তিবাহিনী। যাদের প্রবল মনোবল আর দুঃসাহসী অভিযান কাঁপিয়ে দিচ্ছে শত্রুসেনার বহর। তেমনি এক সময়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্র, দুঃসাহসী, মেধাবী তরুণ দলের সমন্বয়ে গঠন করা হল দুর্ধর্ষ এক গেরিলা দল! মূলত এই গেরিলা বাহিনী তৈরি করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন খালেদ মোশাররফ এবং এটিএম হায়দার। এই দলটি মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের অধীনে একটি স্বতন্ত্র গেরিলা দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যারা মূলত গণবাহিনীর অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতের মেঘালয়ে ‘মেলাঘর’ ক্যাম্পে এই দলটি ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দারের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। মূলত ট্রেনিংয়ে গ্রেনেড ছোড়া থেকে শুরু করে ঝটিকা আক্রমণ, অতর্কিত হামলা করে ত্রাস সৃষ্টি করা, অ্যাটাক করে দ্রুততার সাথে আত্মগোপন করা, সর্বোপরি আরবান গেরিলা যুদ্ধের সব কলাকৌশল তারা খুবই ভালোভাবে আয়ত্ত করে।
ক্র্যাক প্লাটুন বা গেরিলা বাহিনী তৈরির উদ্দেশ্য
তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার এক কূট কৌশলের অংশ হিসেবে বহির্বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সীমান্ত সংঘাত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিয়ে মিথ্যাচার প্রচার করছিলো! পাক প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল বহির্বিশ্ব যাতে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা কোনভাবেই আঁচ করতে না পারে। সেই লক্ষ্যে ঢাকায় যাতে কোন ভাবেই মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করে কোন কার্যক্রম চালাতে না পারে, সেই জন্যে কঠোর নিরাপত্তা ব্যূহ তৈরি করেছিল। মূলত মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। আর ঢাকা ছিল ২নং সেক্টরের অধীন এবং দায়িত্বে ছিলেন কে-ফোর্সের সেনানায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ। মূলত সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ চাচ্ছিলেন পাক সরকারের মিথ্যাচার ধরিয়ে দিয়ে, বহির্বিশ্বের কাছে সত্য এবং সঠিক বার্তা পোঁছে দিতে। যাতে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে যায় এদেশের মুক্তিকামী মানুষ তাদের স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। এটা নিজ দেশকে পরাধীন অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে সমগ্র বাঙ্গালীর একাত্ম লড়াই!
ক্র্যাক প্লাটুন নামকরণের ইতিহাস
১৯৭১ সালে এই দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীটি একটি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল! এই বাহিনীর সাহসী সদস্যরা হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে শত্রুদের উপর নিখুঁত টার্গেটে অতর্কিত আক্রমণ করে দ্রুততার সাথে স্থান ত্যাগ করতে পারতো। ১৯৭১ সালের ৯ জুনের প্রথম সফল গেরিলা অপারেশনের (অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল) খবর মেলাঘরে কমান্ডার খালেদ মোশারফের কাছে পৌঁছালে গর্বভরে তিনি বলেছিলেন, “These are Crack People”! মূলত তার এই উক্তি থেকেই “ক্র্যাক প্লাটুন” নামের সূত্রপাত ঘটে এবং এই গেরিলা বাহিনীটি সবখানে এই নামেই পরিচিতি লাভ করে!
গেরিলা অপারেশন
১৯৭১ সালে ঢাকায় এই ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনী ছোট বড় মোট ৮২টি দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেছিল। এই বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যরা পাঁচ-ছয় জন মিলে একেকটা ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন সফলভাবে করে ফেলতে পারতো! এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু অভিযান হলোঃ অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল, অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট, অ্যাটাক অন দ্য মুভ, ডেস্টিনেশন আননোন প্রভৃতি। এসব গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনী পাকসেনা এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের মধ্যে চরম আতংক ও ভীতির সঞ্চার করে তোলে।
এই অসীম সাহসী বাহিনীর হামলাগুলোর মাধ্যমেই বিশ্ববাসীর দুয়ারে পৌঁছে যায়, এই দেশে একটি স্বাধিকার আন্দোলন তথা অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ চলছে। বিশ্ববাসী আসল সত্যটা জেনে যায় এবং পাকিস্তানী সরকার সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর যে মিথ্যা প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মূলত এর ফলে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকারের মিথ্যাচারের মুখে অমোচনীয় এক কালিমা লেপন হয়ে যায়! আসলে সত্য হলো আগুনের মতোই, ছাইচাপা দিয়ে তার স্ফুলিঙ্গ দাবিয়ে রাখা যায় না। সেই সময় অবিচার, অন্যায় আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙ্গালির দীর্ঘ সময়ের বিক্ষোভের আগুন জেগে উঠেছিল। তা কোনভাবেই দাবিয়ে রাখা কিংবা রুখে দেওয়ার মতো কোন শক্তিই তখন কারো ছিলো না!
মাতৃভূমির জন্য সাহসী আত্মত্যাগ
ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনীর অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পাক আর্মি এদের ধরতে পুরো ঢাকা শহর চষে বেড়ায়। এমনকি তারা এদের ধরে দেওয়ার জন্য দুই হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করে। ১১ আগস্টের হামলার পর পাকবাহিনীর চিরুনি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে এবং এদেশীয় কিছু দোসরের সহযোগিতায় ধরা পড়ে যায় বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যরা! ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট রেইড চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রায় ১৫ জন গেরিলা যোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ধরে টর্চার সেলে নিয়ে নির্মমভাবে অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়। নিষ্ঠুর টর্চারের মুখোমুখি হয়েও তারা একজনও মুখ খুলেননি এবং নতি স্বীকার করেননি! পরবর্তী সময়ে এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে নয়জনের আর কোন খোঁজই পাওয়া যায়নি! আমাদের স্বাধীনতার আস্বাদ পাইয়ে দিতে গিয়ে, তারা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন কালের অতল গর্ভে!
ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনীর পুনর্গঠন
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকেই আবারো ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা পুনর্গঠিত হয়! প্রথম পর্যায়ের কয়েকজন গেরিলাসহ দ্বিতীয় পর্যায়ের আরও অনেকজন গেরিলার সমন্বয়ে ক্র্যাক প্লাটুন পুনরায় তাদের বিধ্বংসী অভিযান শুরু করে। তৎকালীন ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা যেমন-বাসাবো, মানিক নগর, বাড্ডা, উত্তরখান প্রভৃতি এলাকায় গেরিলা অপারেশন শুরু করে। আর তাদের এই গেরিলা কার্যক্রম বিজয় অর্জনের আগের দিনটি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মূলত ক্র্যাক প্লাটুনের মোট সদস্য সংখ্যার তালিকাটা সেভাবে পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অনুমান করা হয়, এই স্পেশাল কমান্ডো বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল শতাধিকেরও উপরে!
শিল্প-সাহিত্যে ক্র্যাক প্লাটুন
শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে ক্র্যাক প্লাটুনের সাহসী ভূমিকা বহুবার তুলে ধরা হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তাদের অবদানের কথা জানে এবং তাদের মতোই আদর্শ ও সাহসী দেশপ্রেমিক মানুষ হওয়ার দীক্ষা পায়, সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন মিডিয়ায় এই বীরদের আত্মত্যাগের কাহিনী নানাভাবে উঠে এসেছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে তার ছেলে রুমী এবং ক্র্যাক প্লাটুন দলের অন্যান্য সদস্যদের কথা এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবহুল দিনগুলো উঠে এসেছে। ক্র্যাক প্লাটুন দলের অন্যতম সদস্য শহীদ আজাদ এবং তার মাকে কেন্দ্র করে আনিসুল হক লিখেছেন জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মা’। লেখক এই উপন্যাসে আজাদ ও তার মায়ের জীবন সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের কথা খুব হৃদয়স্পর্শী ভাবে তুলে ধরেছেন।
এশিয়াটিক সোসাইটি এই গেরিলা বাহিনীর দুঃসাহসিক গল্পগুলো নিয়ে প্রকাশ করেছিল ‘ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধ ১৯৭১’ নামের একটি বই। আবার ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের লেখা ‘ব্রেভ অব হার্ট’ বইটিতে এই বাহিনীর নানা ঘটনাবহুল অজানা তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও এই বিচ্ছু বাহিনীর কথা তুলে ধরে ১৯৯৪ সালে সরকারি অনুদানে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মুভি ‘আগুনের পরশমণি’। প্রয়াত জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ক্র্যাক প্লাটুন দলের অন্যতম সদস্য শহীদ বদিউল আলম বদিকে কেন্দ্র করে এই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এই সিনেমাটি ১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করে।
আমাদের বিজয় এনে দিতে গিয়ে একাত্তরের সূর্য সন্তানেরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছেন! আর তাইতো শহীদ জননী জাহানারা ইমামের শূন্য কোল আর কোন দিনই পূর্ণ হয়নি! কিংবা শহীদ আজাদের মা নিজ হাতে আর সন্তানের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে পারেননি! মায়ের আঁচলের সুশীতল ছায়ায় বেড়ে ওঠা বীর সন্তানেরা, দেশ মাতৃকার সম্মান রক্ষার্থে হাসিমুখে নিজেদের অমূল্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন! তারা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন কিন্তু তাদের সাহসী আত্মদানের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে আছেন প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয় জুড়ে। এই মহান বিজয়ের মাসে প্রহরীর পক্ষ থেকে অসীম সাহসী সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রইলো শতকোটি বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা!
তথ্যসূত্র:
১। ইন্টারনেট, “একাত্তরের দিনগুলি”-জাহানারা ইমাম, “আলতাফ”-অমিত গোস্বামী, “মা”-আনিসুল হক।