প্রহরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি
পড়তে লাগবে: 5 মিনিট

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ঐতিহাসিক কিছু গাড়ির গল্প

ছোট একটা শব্দ “মুক্তিযুদ্ধ” যার সাথে আমাদের আবেগ,অনুভূতি কিংবা জড়িয়ে আছে ভয়ংকর বিচিত্র অভিজ্ঞতা। যুদ্ধে কেবল আমরা প্রাণ হারালাম তা নয় সাথে হারালাম বহু মূল্যবান সম্পদ সামগ্রী ও। সময় চলেও অতীত কিন্তু ভূলে থাকা যায় না। ১৯৭১ সালের,মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক এই ৯ টি মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে এই গাড়িগুলি। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গ দিতে গিয়ে কোনটা আবার গুলির আঘাতে হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। ইতিহাসের দাগ বয়ে বেড়ানো এমন গাড়িগুলোর মধ্যে কিছু গাড়ি বন্দি বর্তমানে যাদুঘরের চারদেয়ালে, কোনটা আবার পরে আছে অযত্নে অবহেলায়। চলুন তো আজকে জেনে নেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি কথা, সাথে সেই গাড়িগুলোর সাথে জড়িয়ে থাকা কিছু ইতিহাসও।

শেভরোলেট ১৯৫৬

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ এই গাড়িটির সাথে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামও। বোঝাই যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায় গাড়িটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ্য। চট্টগ্রাম ক-২১৩৩ নম্বরপ্লেটের গাড়িটির আসল মালিক চট্টগ্রাম বনবিভাগ। সেখান থেকে গাড়িটি পাকবাহিনী ব্যবহার করতে থাকে যুদ্ধের সময়। আর তাদের থেকেই গাড়িটি মূলত মুক্তিবাহিনী হাইজ্যাক করে নেয়। এরপর থেকে যুদ্ধের পুরোটা সময় গাড়িটি মুক্তিবাহিনী ব্যবহার করে যুদ্ধের বিভিন্ন সরঞ্জাম আনা নেয়ায়।

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি - শেভরোলেট

বলছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে গাড়িটি জড়িত থাকার কথা। শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়, সাথে জিয়াউর রহমান, আইয়ুব খান- মোট ৩ জন রাষ্ট্রপতি এই গাড়িটি ব্যবহার করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে। বর্তমানে গাড়িটির দেখা পাওয়া যাবে ঢাকার উত্তরখানে অবস্থিত মাহমুদুল ফারুক নামের এক শৌখিন ব্যাক্তির খামারবাড়িতে। গাড়িটিতে এখনো রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গুলির ক্ষতচিহ্ন।

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি - শেভরোলেট

ওল্ডসমোবিল ১৯৫৩

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি - ওল্ডসমোবিল

মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে এই গাড়িটি ব্যবহৃত হতো তৎকালীন পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বেশ আগেই দূতাবাস থেকে গাড়িটি বিক্রি করে দেওয়া হলে সেটি কিনে নেন ফরিদপুরের এক হিন্দু ব্যবসায়ী। তারপরই শুরু হলো ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। পাকহানাদার বাহিনী সেই হিন্দু ব্যবসায়ীকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করলো তার বাড়িতে। সেদিন তাকে না পেয়ে পাকবাহিনী চড়াও হয় সেই ব্যবসায়ীর প্রিয় গাড়ির উপর। গুলিবর্ষণে ঝাঁঝরা হয়ে যায় গাড়িটির সামনের দিক। পরবর্তীতে একজন ভাঙ্গারি ব্যবসায়ি গাড়িটি কিনে নিয়ে আসেন ঢাকায়। সেখান থেকেই শৌখিন গাড়ি সংগ্রাহক মাহমুদুল ফারুক গাড়িটি নিজের সংগ্রহে যোগ করেন।

কাইজার উইলিজ জিপ ওয়াগনার

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি - কাইজার উইলিজ জিপ ওয়াগনার

জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক।এই ঐতিহাসিক গাড়িটি একসময় তিনি ব্যবহার করতেন।যশোর ব-১৪৬ নম্বরপ্লেটের নীল রঙা এই গাড়িটি নিয়েই ওসমানী সাহেব যুদ্ধকালীন বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে যেতেন। গাড়িটি যশোর শিক্ষা বোর্ডের মালিকানাধীন ছিলো বলে জানা যায়। যুদ্ধের পরও যশোর শিক্ষা বোর্ড গাড়িটি ব্যবহার করে। তবে বর্তমানে গাড়িটির দেখা মেলবে বাংলাদেশ সামরিক যাদুঘরে।

ভি ডব্লিউ টাইপ-থ্রি বাস

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি - ভি ডব্লিউ টাইপ-থ্রি বাস

মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত আরেকটি গাড়ি এই মাইক্রোবাসটি। জানা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালে এই গাড়িটিতে করেই চুয়াডাঙ্গা যান। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে যশোর ব-২১৪ নম্বরপ্লেটের গাড়িটি ব্যবহার করেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রাজেক আহম্মেদ। জানা যায় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যশোর নিউমার্কেট এলাকায় পাকহানাদার বাহিনীর সাথে একটি সম্মুখযুদ্ধে গাড়িটি ব্যবহার হয়েছিলো। এই গাড়িটিতে করেই ৩ জন পাকিস্তানী সেনাকে আটক করে আনা হয়। যুদ্ধের সাক্ষী এই গাড়িটি বর্তমানে যশোর কালেক্টরেট এলাকায় সংরক্ষিত আছে।

মার্সিডিজ বেঞ্জ ডব্লিউ ১৫

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি - মার্সিডিজ বেঞ্জ ডব্লিউ ১৫

শুধু স্বাধীনতার পক্ষের মানুষেরই নয়, শত্রুপক্ষের ব্যবহৃত গাড়িও রয়ে গেছে বাংলাদেশের সংগ্রহশালায়। মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি টি বর্তমানে বাংলাদেশের সামরিক জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। গাড়িটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ব্যবহার করতো। যুদ্ধশেষে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রয়ে যাওয়া গাড়িটি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সেনাপ্রধান থাকাকালীন ব্যবহার করেন। জার্মানিতে তৈরি ০০০০০৫ নম্বরের কালো গাড়িটি পরিচিত ছিলো ‘স্টাফ কার’ হিসেবে।

হবিগঞ্জের লাল জীপ

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি - হবিগঞ্জের লাল জীপ

এখনকার সময়ের বিভিন্ন জেলার ডিসি বা জেলা প্রশাসককে সেই সময়ে বলা হতো এসডিও বা মহাকুমা প্রশাসক। হবিগঞ্জের তৎকালীন এসডিও বা মহাকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব আকবর আলী খান। যুদ্ধের প্রথম থেকেই তিনি স্থানীয় ট্রেজারি চাবি, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন।এতোসব সাহায্যের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ একটি ছিল লাল রঙের এই জীপ গাড়িটি। মুক্তিযুদ্ধের কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী গাড়িটি ব্যবহার করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের আনা নেয়া থেকে শুরু করে, খাদ্য, অস্ত্র পরিবহণসহ নানা কাজে। যুদ্ধকালীন সময়ে জিপটিতে চলাচল করেছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক জেনারেল এমএ রব, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদসহ আরো অনেকজন মুক্তিযোদ্ধা। ইতিহাসের সাক্ষী সেই সময়ের টকটকে লাল রঙের টয়োটা জীপটি বর্তমানে হবিগঞ্জের ডিসি অফিসের দোতলার ছাদে জীর্ণ-শীর্ণ, বিবর্ণ অবস্থায় অবহেলায়ই পড়ে আছে। জীপটি সংরক্ষনের জন্য জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সভায় আলোচনা হলেও, এখন পর্যন্ত ঐতিহাসিক গাড়িটি সংরক্ষণে নেয়া হয়নি তেমন কোন উদ্যোগ।

ডা. ফজলে রাব্বীর মরিস মাইনর ১০০০

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি - ডা. ফজলে রাব্বীর মরিস মাইনর ১০০০

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, বিজয়ের একদম অন্তিম মুহূর্তে পাকবাহিনীর করা জঘন্যতম বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের একজন বলি ডা. ফজলে রাব্বী। স্বর্ণপদকজয়ী এই মেধাবী চিকিৎসক নিজ হাতে রাইফেল চালিয়ে যুদ্ধ না করলেও, ডাক্তার হিসেবেই নিজেকে দেশের মুক্তির যুদ্ধের জন্য বিলিয়ে দিয়ে গেছেন যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত। যুক্তরাজ্যে তৈরি মরিস মাইনর ১০০০ মডেলের গাড়িটি প্রথম বাজারে আসে ১৯৬৫ সালে। ব্যাক্তিগত ব্যবহারের জন্য কেনা শখের কালো রঙের এই গাড়িটিতে করেই ডা. ফজলে রাব্বি বহন করতেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের, আনা- নেয়া করা হতো দরকারি ওষুধপত্র ও চিকিৎসার সরঞ্জাম, কখনো খাবারও। বর্তমানে ঢাকার আগারগাওয়ের মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরে যত্নেই প্রদর্শিত আছে কালো রঙের পুরনো মডেলের গাড়িটি।

মিডিয়াম উদ্ধারযান ৬ বাই ৬ মডেল এম৫৪৩

মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর শক্তিশালী এই গাড়িটি উদ্ধার করা হয় পাকবাহিনীর কাছ থেকে। এটি মূলত ছিল একটি উদ্ধারকারী গাড়ি, যা ৫.০৮ মেট্রিক টন পর্যন্ত ওজনের গাড়ি টানতে পারতো। এধরণের গাড়ি সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্যবহারের পর উদ্ধারকারী এই ভারী গাড়িটির স্থান হয় বাংলাদেশ সামরিক যাদুঘরে।

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি - মিডিয়াম উদ্ধারযান ৬ বাই ৬ মডেল এম৫৪৩

এগুলো ছাড়াও যুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাঙ্ক, কার্গোসহ আরো অনেক গাড়িই ব্যবহার হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়, স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের বাহিনীর হাতে। যার মধ্যে একটা বড় অংশ যুদ্ধ শেষে রয়ে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। এদের মধ্যে অনেকগুলোই সরকারী ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভালো অবস্থানে সংরক্ষিত থাকলেও, অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা গাড়ির সংখ্যাও একদম কম না। দেশের ইতিহাসের এমন অংশগুলি মাটির সাথে মিশে যাওয়ার আগেই সঠিক তত্ত্বাবধানে সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা গেলে, আমাদের সামনের প্রজন্মও আরো কাছ থেকে দেখা ও জানার সুযোগ পাবে নিজেদের ইতিহাস। তো এই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ি সম্পর্কে কিছু তথ্য।

শখের গাড়ির সকল তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে এবং গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী ব্যবহার করতে পারেন। এটি একটি ভেহিক্যাল ট্র্যাকার সার্ভিস (VTS) ডিভাইস যা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে পাই ল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রহরী – ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং সিস্টেমে রয়েছে অ্যাপের মাধ্যমে ইঞ্জিন লক/আনলক করার সুবিধা, গাড়ির লাইভ ট্র্যাকিং আপডেট দেখা, এবং ট্রাভেল হিস্টোরি চেক করা সহ আরও অনেক সুবিধা বিস্তারিত জানতে দেখুন প্রহরী প্যাকেজ সমূহ।

    গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী সম্পর্কে জানতে

    Share your vote!


    এই লেখা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
    • Fascinated
    • Happy
    • Sad
    • Angry
    • Bored
    • Afraid

    মন্তব্যসমূহ

    Scroll to Top