বাংলাদেশে গত দশ বছরে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। শহর থেকে শুরু করে জেলা শহরগুলোতেও এখন অনেকেই নিজের গাড়ি ব্যবহার করছেন। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা যত বাড়ছে, চোরদের নজরও ততই বাড়ছে। গাড়ি নিয়ে অনেক সচেতন থাকলেও, অনেক সময় আমরা বুঝতেও পারি না দিনে দিনে গাড়ি চুরির ঝুঁকি কতটা বড় সমসযা হয়ে উঠেছে। গাড়ি চুরির নির্ভরযোগ্য সরকারি তথ্য খুব বেশি নেই, কিন্তু পুলিশ, সংবাদপত্র আর বাজারের থাকা বিভিন্ন সেকেন্ডারি রিপোর্ট দেখে বোঝা যায় গাড়ি চুরি এখন একটি সময় উপযোগি সমস্যা। তাই এই বিষয়ে এখনই গাড়ির মালিকদের সতর্ক হওয়া দরকার। আজকের ব্লগে আমরা জানব, দেশে গাড়ি চুরির অবস্থা কেমন, কেন ঝুঁকি বাড়ছে, আর কীভাবে কয়েকটা সহজ পদক্ষেপ নিয়ে আপনি আপনার গাড়িকে নিরাপদ রাখতে পারেন।
গাড়ি চুরির সংখ্যা কি বলে?
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) নিয়মিতভাবে তাদের ওয়েবসাইটে মাসিক অপরাধের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে। সেখানে গাড়ি চুরি ও উদ্ধারের তথ্যও উল্লেখ থাকে, যা প্রমাণ করে যে গাড়ি চুরি রাজধানীর অপরাধ পরিসংখ্যানে নিয়মিতভাবে নজরদারিতে আছে। এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিবছর সারাদেশের অপরাধের বার্ষিক প্রতিবেদন (PDF আকারে) প্রকাশ করে, যেখানে গাড়ি চুরির তথ্যও দেখা যায়। এসব তথ্য দেখায় যে গাড়ি চুরি একটি চলমান এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
অন্যদিকে, দেশে গাড়ির মালিকানা গত কয়েক বছরে বেড়েছে। যদিও অর্থনৈতিক চাপের কারণে ২০২৩ সালে যেখানে ৩.৬১ লাখ নতুন গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল, ২০২৪ সালে তা কমে প্রায় ৩.০৮ লাখে নেমে এসেছে। তবুও দেশের মোট গাড়ির সংখ্যা বিশাল, যা চোরদের জন্য একটি বড় টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও প্রায়ই দেখা যায়—ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গাড়ি চুরির খবর বা চোর চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান। শুধু পুরো গাড়ি নয়, অনেক সময় আলাদা যন্ত্রাংশ যেমন সাইড মিরর, ব্যাটারি বা হেডলাইটও চুরি হচ্ছে—এমনকি ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ানো অবস্থাতেও। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে গাড়ি চুরির নির্দিষ্ট হার প্রকাশ না হলেও, এর ঝুঁকি বেশ উচ্চ, বিশেষ করে ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে।
কেন গাড়ি চুরির চোরদের কাছে লোভনীয়?
সহজে বিক্রি হয়, দামও ভালো
চুরি করা গাড়ি বা তার যন্ত্রাংশ দ্রুত বিক্রি করা যায়। অনেক সময় অন্য জেলায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে ফেলা হয়। সংগঠিত চক্রগুলো খুব দ্রুত গাড়ি খুলে ফেলে বা নকল রেজিস্ট্রেশন করে বিক্রির চেষ্টা করে। একসাথে অনেক গাড়ি উদ্ধার হওয়ার ঘটনাগুলোই দেখায়—এরা কতটা সংগঠিতভাবে কাজ করে।
শহরের ভিড় চোরদের সুযোগ দেয়
ঢাকার মতো শহরে রাস্তা ভরা গাড়ি, সরু গলি আর পার্কিংয়ের অভাব চোরদের জন্য সুবিধা তৈরি করে। রাতের বেলা রাস্তায় পার্ক করা গাড়ি, বাজারের পাশে বা অফিসের সামনে রাখা গাড়ি—সবই তাদের টার্গেট হতে পারে। এমনকি অনেক সময় ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ি থেকেও যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যায়!
নিরাপত্তার ঘাটতি
অনেক ভবন বা পার্কিং জায়গায় এখনো CCTV নেই, আলো কম, বা গেট ঠিকভাবে বন্ধ হয় না। পুরনো ভবনগুলোতে গার্ডও নিয়মিত থাকে না। তাই অনেক “নিরাপদ” এলাকা থেকেও গাড়ি চুরি হচ্ছে।
রিপোর্ট না করা আর ট্র্যাকার না থাকা
অনেক সময় গাড়ির মালিকরা দেরি করে থানায় রিপোর্ট করেন। আবার ট্র্যাকার বা সিকিউরিটি সিস্টেম না থাকলে গাড়ি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। তাই এখন সময় এসেছে প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়ার – যেমন জিপিএস ট্র্যাকার। এগুলো থাকলে চোরদের কাজের সময় অনেক কমে যায়, ফলে গাড়ি উদ্ধারের সুযোগও বেড়ে যায়।
সংখ্যার আড়ালে থাকা মানুষের গল্প
পরিসংখ্যান এর রিপোর্ট দেখে গাড়ি চুরি একটা শুধু সংখ্যা মনে হতে পারে। কিন্তু যখন আমাদের নিজেদের কারো গাড়ি চুরি হয়, তখন বিষয়টা অনেক কঠিন হয়ে যায়। একটি গাড়ি চুরি হওয়া মানে শুধু অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হওয়া না, এতে পুরো পরিবারের দৈনন্দিন জীবনও থমকে দেয়।
বাংলাদেশে অনেক মানুষ তাদের গাড়ির ওপর নির্ভর করেন প্রতিদিনের কাজকর্ম আর ইনকামের জন্য। কেউ অফিসে যেতে গাড়ি ব্যবহার করেন, কেউ ব্যবসার কাজে বা জরুরি ভ্রমণে। তাই গাড়ি চুরি হলে শুধু টাকা নষ্ট হয় না, পুরো দিনটাও ব্যাহত হয়। এজন্য গাড়ি চুরি রোধ করা এবং যদি কখনো ঘটে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে শুধু অর্থ নয়, পরিবারের সময় এবং সুরক্ষাও বাঁচানো যায়।
গাড়ি চুরি রোধের সহজ কিছু টিপস
বাংলাদেশে গাড়ি চুরি বেড়ে চলেছে। তবে কিছু সাবধানতা নিলে চুরির ঝুঁকি অনেক কমানো যায়। গাড়ি চুরি রোধে শুধু একধরনের নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করে না এতে একাধিক ব্যবস্থা একসাথে নেওয়াই ভালো।
ঠিক জায়গায় গাড়ি পার্ক করুন
গাড়ি পার্ক করার জায়গা বাছাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবসময় এমন জায়গায় গাড়ি রাখুন যেখানে আলো এবং মানুষের উপস্থিতি থাকে। অন্ধকার কোনায় বা খালি জায়গায় গাড়ি পার্ক করবেন না। বাড়িতেও এমন জায়গায় পার্ক করুন যেখানে প্রতিবেশীরা বা সিকিউরিটির লোকজং সহজে দেখতে পায়। গাড়ির উইন্ডো খোলা রাখা উচিত নয়; ছোট ফাঁকও চোররা সহজে ব্যবহার করতে পারে। যদি আপনার প্রাইভেট গ্যারেজ বা লটে যদি ব্যারিয়ারে থাকে, গাড়ি সেই দিকের দিকে রাখুন যাতে চোররা সহজে গাড়ি নিয়ে পালাতে না পারে।
ভালো হুইল কল ব্যবহার করুন
গাড়ির নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য স্টিয়ারিং-হুইল লক ব্যবহার করুন। এটি দামে সস্তা, সহজে দেখা যায় এবং চোরদের থামাতে সাহায্য করে। গাড়িতে শক এবং টিল্ট সেন্সরযুক্ত অ্যালার্ম লাগানো যেতে পারে, এটি গাড়ির ইঞ্জিন চালানোর চেষ্টা আটকাতে পারে। আরও ভালো নিরাপত্তার জন্য ইমোবিলাইজার বা ইঞ্জিন কাট-অফ সিস্টেমও ব্যবহার করা যায়। কিছু আধুনিক ডিভাইস আছে, যা দূর থেকে গাড়ি লক করার সুবিধা দেয়।
জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহার করা
BTRC অনুমোদিত জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহার করুন। এটি লাইভ লোকেশন দেখায়, গাড়ির গতিবিধি সম্পর্কে এলার্ট দেয় এবং জিও-ফেন্স সুবিধা প্রদান করে। জিপিএস ট্র্যাকার ডিভাইস ব্যবহার করলে গাড়ি চুরি হলে তা ফেরানোর সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। অনেক স্থানীয় সার্ভিস প্রোভাইডার, যেমন প্রহরী, ইঞ্জিন লক/আনলক, স্পিড এলার্ট এবং ট্রিপ হিস্টোরির সুবিধা দেয়। সবসময় এমন প্রোভাইডার বেছে নিন যারা ভালো সাপোর্ট দেয় এবং ইনস্টলেশন করে। জিপিএস ট্র্যাকিং গাড়ির মালিক ও পুলিশের জন্য সবচেয়ে কার্যকরি উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম।
বাড়ি ও পার্কিং নিরাপত্তায় নজর দিন
আপনার বাড়ির পার্কিং স্পেসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গাড়ি, প্রবেশ এবং বের হওয়ার রাস্তা সব জায়গায় CCTV বসান। ক্যামেরাতে আসা রেকর্ডিংগুলো সপ্তাহে সপ্তাহে সেইভ রাখুন। প্রতিবেশী এবং নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, যেমন WhatsApp গ্রুপ চালু করতে পারেন যাতে দ্রুত সতর্কবার্তা পাঠানো সম্ভব। গাড়ি পার্ক করার সময় ও জায়গা মাঝে মাঝে বদলান, যাতে চোররা সহজে আপনার গাড়ি রাখার জায়গা কোনটা তা ধরতে না পারে।
গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সংরক্ষন করুন
গাড়ির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র (BRTA রেজিস্ট্রেশন, প্লেট, চ্যাসিস/VIN) ছবি তুলে নিরাপদভাবে অনলাইনে রাখুন, কিছু জায়গায় পেইন্ট ডট বা UV মার্ক দিয়ে চিহ্ন দিন, ফোনে একটি “চুরি চেকলিস্ট” রাখুন যাতে পুলিশ, জিপিএস ট্র্যাকার প্রোভাইডার ও বীমা কোম্পানির নম্বর আছে, গাড়ি অরজিনাল কাগজ সবসময় বহন করবেন না। প্রয়োজনে কপি দেখান, আর নিয়মিত এসব তথ্য আপডেট করে রাখুন।
গাড়ি চুরি হলে কি করবেন?
গাড়ি চুরি হলে দ্রুত করুণ: প্রথমে ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশকে পুরো বিবরণ দিন – গাড়ির মডেল, রং, প্লেট নম্বর এবং শেষ দেখা জায়গা। ট্র্যাকার অ্যাপ চালু করে লোকেশন শেয়ার করুন এবং আশেপাশের নিরাপত্তা/প্রতিবেশীদের জানান। সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল ডায়েরি (GD) করুন। তারপর বীমা কোম্পানিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জানিয়ে দিন যেন কভারে থাকে। দ্রুত কাজ করলে গাড়ি ফেরানো বা ক্লেইম পাওয়া সহজ হয়।
শেষকথা
গাড়ি চুরির পরিসংখ্যান যেমন আমাদের সমস্যা জানায়, তেমনি সেটা সচেতনতাও জরুরি করে তোলে। তাই কাগজপত্র নিয়মিত আপডেট রাখা, ভালো জায়গায় পার্ক করা, স্টিয়ারিং লক/অ্যালার্ম ব্যবহার করা ও BTRC-অনুমোদিত জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহার করা। এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই আপনার বড় ধরনের ক্ষতি আটকাতে পারে।