অপেক্ষার পালা শেষ! পুরো অর্থের যোগাড় না করে আপনিও হতে পারেন গাড়ির মালিক। কার লোনের মাধ্যমে কিনতে পারেন আপনার স্বপ্নের গাড়িটি। মধ্যবিত্তদের জন্য এই লোন নিয়ে গাড়ি কেনা অনেক সহজ। বর্তমানে গাড়ি কেনার জন্য অসংখ্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার লোন সুবিধা দিচ্ছে। যে কারণে গাড়ি কেনা অনেক সহজ হয়ে গেছে।
তবে এর জন্য রয়েছে কিছু নিয়ম। এসব প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া,সুদের হার,পরিশোধের মেয়াদ,অনলাইনে আবেদনের নিয়ম জানতে হয়। আবার ঋন পেতে হলে কি যোগ্যতা থাকতে হয়,কি কি কাগজপত্রের দরকার হয় এসব তথ্যও জানতে হয়। তাহলে গাড়ি কেনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। তবে কার লোন কি,কোথায় পাবেন,কার লোন কিভাবে পাবেন, ইন্টারেস্ট রেট কত এসকল তথ্য অনেকেই জানেন না। তাদের সুবিধার্থেই আজকের আর্টিকেলটি লেখা।
কার লোন কি?
কার লোন হলো গাড়ি কেনার জন্য টাকা ধার করা। তবে কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে ধার নয়। বরং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুধুই গাড়ি কেনার জন্য ধার দেওয়ার প্রক্রিয়াকে কার লোন বা অটো লোন বলে। এজন্য গাড়ি ক্রেতাকে কিছু নিয়ম মানতে হয় এবং যোগ্যতার অধিকারী হতে হয়। এদেশে গাড়ি কিনতে ঋণ দেওয়া খুব বেশি পুরনো আইডিয়া নয়। কিন্তু উন্নত দেশে সবাই এভাবেই লোন করে গাড়ি কিনে থাকে।
কার লোনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সহজ শর্ত ও প্রতিযোগিতামূলক সুদহার। গাড়ির ক্রয়মূল্যের অর্ধেকেরও বেশি অর্থ ঋণ পাওয়া যায়। এছাড়া জামানত হিসেবে গাড়িটিকেই রাখা হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে বাড়ি/ফ্ল্যাট /জমিও জামানত হিসেবে রাখা যায়।
গাড়ি কেনার জন্য ঋণ কোথায় পাবেন?
লোন করে গাড়ি কিনতে চান কিন্তু সেটি কেনার জন্য ঋণ কোথায় পাবেন, এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। দেশের তালিকাভুক্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই কার লোন দিচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলোর চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার লোন পাওয়া সহজ বেশি ও শর্ত কম। এছাড়া বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠান গাড়ি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কার লোনের বিভিন্ন চুক্তিতে যুক্ত হচ্ছে। যা গ্রাহকের জন্য আরও সুবিধা আনছে। গাড়ি কিনতে কার লোন কোথায় পাবেন এই চিন্তা কমাতে জানাব কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম নাম। যারা কার লোন দিয়ে থাকে।
ব্যাংকের নামঃ সিটি ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইউসিবি ব্যাংক, এমটিবি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, এবং মিডল্যান্ড ব্যাংক।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামঃ আইডিএলসি, আইপিডিসি, লঙ্কাবাংলা, ন্যাশনাল ফিন্যান্স লিমিটেড , প্রিমিয়ার লিজিং এন্ড ফিন্যান্স লিমিটেড , SFIL Finance PLC, First Finance Limited, DBH Finance, উত্তরা ফিন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফিন্যান্স, পিপলস লিজিং, এবং ডেলটা ব্র্যাক হাউজিং ফিন্যান্স ।
যোগাযোগের মাধ্যম
কার লোন দেয় এমন প্রতিষ্ঠানের নাম জানার পর যেকোনও একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করতে হবে। তারপর প্রতিষ্ঠানটির সাথে যোগাযোগ করা যায়। পরিচিত কেউ যদি উক্ত প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তাহলে তার মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়। এটা সম্ভব না হলে সরাসরি প্রতিষ্ঠানটির মেইন অফিস বা শাখা অফিসে গিয়ে কথা বলা যায়। আর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো অনলাইনে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেইজে দেওয়া নম্বরে সরাসরি কথা বলা বা মেসেজ দেওয়া। আপনার জিজ্ঞাসার উত্তরে নিশ্চয়ই কোনও না কোনও কর্মী সাড়া দিবে। তখন আপনি ঋণে গাড়ি কেনার প্রক্রিয়া ও অন্যান্য তথ্য জেনে নিবেন।
সুদের হার
কার লোন নেওয়ার আগে সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসা থাকে সুদের হার নিয়ে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের লোনের নিয়ম আলাদা। লোন দেওয়ার আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার প্রয়োজন, যোগ্যতা, আয় এবং পরিশোধের ক্ষমতা দেখে। সেই অনুযায়ী ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করে। কার লোনের সুদের হারও প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন হয়। অনেকে সুদের হার কম এমন প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে। তবে ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ইন্টারেস্ট রেট অনুসরণ করা হয়। এজন্য জেনে নিন ইন্টারেস্ট রেট সম্পর্কে। এই হার বর্তমানে ১৩.৪৯%-১৫.৪৯%।
তবে কার লোনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানভেদে এই ইন্টারেস্ট রেটের তারতম্য হয়ে থাকে। যেমন ব্র্যাক ব্যাংক কার লোনে ৮.৫০% ইন্টারেস্ট রেট নির্ধারণ করেছে। আবার আইপিডিসিবিডি এই রেট ৮% রেখেছে। এরকম এক এক প্রতিষ্ঠান এক এক ইন্টারেস্ট রেটে কার লোন দেয়।
পরিশোধ মেয়াদ
প্রতিটি লোন পরিশোধের যেমন নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে, তেমনি কার লোন পরিশোধেরও মেয়াদ আছে। বাংলাদেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত কার লোনের মেয়াদ ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান ৬ বছর পর্যন্ত লোন পরিশোধের মেয়াদ দিয়ে থাকে।তবে আপনি যদি পরবর্তীতে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই লোন পরিশোধ করতে চান সেটিও সম্ভব।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অফিশিয়াল ডকুমেন্টেশন লিংক বা অনলাইনে আবেদনের লিংক
কার লোনের জন্য সরাসরি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অফিসে গিয়ে আবেদন করতে হয়। তবে বর্তমান সময়ে অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ হওয়ায় সেই ঝামেলাটা কমেছে। সংশ্লিষ্ট এসব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গেলে অফিশিয়াল ডকুমেন্টেশন লিংক বা অনলাইনে আবেদনের লিংক পাওয়া যাবে। এই লিংকে ক্লিক করলে আবেদন ফরম আসবে। প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সেই ফরম পূরণ করতে হবে। এখানে কয়েকটি ব্যাংক ও নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের অনলাইন আবেদন ফরম লিংক দেওয়া হলোঃ এবি ব্যাংক, আইপি ডিসি বিডি, ব্রাক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, লংকা বাংলা, ঢাকা ব্যাংক, IDLC, ইস্টার্ন ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, DBH Finance, এবং মিডল্যান্ড ব্যাংক।
কার লোন কিভাবে পাবেন?
মধ্যবিত্তদের গাড়ি কেনার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার লোন দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে। কার লোন কিভাবে পাবেন এই জিজ্ঞাসা যাদের তারা নিচের তথ্যগুলো দেখুন। আপনি ইচ্ছা করলেই কোনও ব্যাংকে গিয়ে গাড়ি কেনার জন্য ঋণ চাইলে তারা দিবে না। এর কারণ হলো নিয়ম। প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেনের নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এসব নিয়ম সঠিকভাবে পালন করতে পারলে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত কার লোনটি পেতে পারেন।
এজন্য আপনার মাসিক আয় কত তা জানাতে হবে,আপনার কি কি সম্পদ আছে ক্ষেত্র বিশেষে তাও জানাতে হবে। আপনার বয়স, চাকুরীর ধরন,ব্যবসায়ের ধরণ ইত্যাদি তথ্যও দিতে হয়। এসব তথ্য বিবেচনা করে আপনাকে যোগ্য মনে করলে কার লোন পেয়ে যাবেন।
ঋণগ্রহীতার যোগ্যতা
কার লোন কোথায় পাবেন, কিভাবে পাবেন এসব জানার পর আসে ঋণগ্রহীতার যোগ্যতার প্রশ্ন। কারণ ঋণগ্রহীতার বয়স,মাসিক আয়, চাকরী স্থায়ী না অস্থায়ী,ব্যবসার বয়স অনুযায়ী ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হবে।
- ঋণগ্রহীতার বয়স ২১ থেকে ৬৫ বছর হতে হবে
- মাসিক আয় চাকুরিজীবীদের জন্য ৩০-৪০০০০ টাকা,ব্যবসায়ীদের ৫০-৭৫০০০ টাকা,কোনও বাড়ি/জমি/ফ্ল্যাট বন্ধক রাখলে ৫০০০০ টাকা হতে হবে
- চাকরীর বয়স ২ বছর হতে হবে
- চাকরী স্থায়ী হতে হয়
- ব্যবসায়ী হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বয়স ৩-৫ বছর হতে হয়
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
কার লোন পেতে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের আবেদনপত্র পূরণ করতে হলে যোগ্যতা প্রমাণের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করতে হয়। এই কাগজগুলোর মধ্যে আছে-
১. ন্যাশনাল আইডি কার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট সাইজ ছবি – ২ কপি
২. ব্যাংক স্টেটমেন্ট
৩. চাকুরিজীবীদের জন্য স্যালারি স্টেটমেন্ট
৪. অফিস থেকে প্রদত্ত আইডি কার্ড বা ভিজিটিং কার্ড
৫.ব্যবসায়ীদের জন্য মেমোরেন্ডাম ও ট্রেড লাইসেন্স
৬.বাসার ঠিকানা ও আগের মাসের বিদ্যুৎ বিলের কপি
৭..বাড়ি/ ফ্ল্যাট/ জমি বন্ধক রাখলে সেগুলোর দলিল।
৮.ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন এর স্লিপ (গ্রাহকের স্বাক্ষরসহ)
৯.আর যে গাড়ি কিনতে চান তার মূল্য তালিকা।
আবেদনের নিয়ম (শুরু থেকে শেষ)
ঋণের মাধ্যমে গাড়ি কিনতে ইচ্ছুক ক্রেতা সময় বাঁচাতে চাইলে অনলাইনে আবেদন ফরম পূরণ করে সাবমিট করবেন। এটা না করলে সরাসরি অফিসে গিয়েই প্রদত্ত আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে পারেন। তবে উভয় ক্ষেত্রেই আবেদনের নিয়ম এক। এখানে চাওয়া যাবতীয় তথ্যাদি উল্লেখ করতে হবে। ফরম সাবমিট হয়ে গেলে ও তথ্যাদি সঠিক হলে দ্রুতই আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে। কর্তৃপক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে আপনি কার লোনটি পাচ্ছেন কি না। এতে যোগ্য বিবেচিত হলে আপনাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সরাসরি অফিসে যেতে হবে।
অফিস কর্তৃপক্ষ আপনার কাগজপত্র দেখে সঠিক মনে করলে আপনাকে লোনের টাকা দেওয়া হবে। এই টাকা গাড়ি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে জমা দিয়ে আপনি পেয়ে যাবেন আপনার স্বপ্নের গাড়ি। মধ্যবিত্তদের জন্য গাড়ি কেনার স্বপ্ন পূরণে কার লোন একটি সুন্দর সমাধান। যারা কার লোন কোথায় পাবেন, এর ইন্টারেস্ট রেট ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চান তাদের জন্য ছিলো উপরের তথ্যাবলি।
তবে গাড়ি কেনার খুশিতে এই কথা ভুললে চলবে না যে, গাড়ি কেনার পর এর রক্ষণাবেক্ষণ করাও ব্যয়সাপেক্ষ। তাই লোন পরিশোধ হওয়া পর্যন্ত এই ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে। নইলে গাড়িও যাবে, টাকাও যাবে। তাছাড়া নিজের আয় অবশ্যই স্থিতিশীল বা বৃদ্ধি ব্যতীত না কমে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। নাহলে ঋণ বাকি থাকতে পারে। সেই সুযোগে ঋণদাতারা গাড়ি জব্দ করে নিয়ে যেতে পারে।
শেষ কথা
গাড়ি ক্রয় শুধুমাত্র একটি চাহিদা বিষয়টি এমন নয়। অনেকেই একটি ছোট গাড়ি ক্রয়ের স্বপ্ন দেখেন। হতে পারে তা রিকন্ডিশন গাড়ি কিংবা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। আপনার শখের গাড়ি কেনার স্বপ্ন যেন বাস্তবায়ন হয়, তাই আমাদের আজকের এই ব্লগটিতে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করা হয়েছে। আশা করি, ভালো থাকবেন, গাড়ি ক্রয় করলে কিন্তু প্রহরী ব্যবহার করতে ভুলবেন না!