প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। দিন দিন বেড়েই চলেছে যার হার। চালকের বেপরোয়া মনোভাব, অতিরিক্ত গতি থেকে শুরু করে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি, দুর্ঘটনার পেছনে চিহ্নিত করা যায় নানান কারণ। সবাই মানুক আর না মানুক, সড়ক পথের গাড়ি দুর্ঘটনাগুলোর সিংহভাগ দায় দিতে হবে গাড়ির ড্রাইভার ও ড্রাইভারের সচেতনতার অভাবকেই। যেহেতু একটি গাড়ির চলন্ত অবস্থায় তার পুরো নিয়ন্ত্রণটাই থাকে গাড়ির চালকের হাতে, সেই হিসেবে বলা যায় ড্রাইভিং এর সময় বেশ কিছু বিষয়ে গাড়ির চালকের সচেতনতা ও সতর্কতাই দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে অনেকাংশে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ
আমরা জানি ড্রাইভিংয়ের সময় কোন বিষয়গুলোর প্রতি অসতর্কতা বাড়িয়ে দেয় দুর্ঘটনার ঝুঁকি। কিংবা কোন বিষয়গুলোতে সচেতন ও সতর্ক হলে কমতে পারে সড়কে দুর্ঘটনার হার। বিষয় যেমনি হোক আমরা চাই না এমন দুর্ঘটনা বার বার পত্রিকার পাতায় আসুক। আসুন জেনে নেই যে ১০টি কারণ আমাদের দুর্ঘটানার হার বাড়ায়ঃ
১. অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিংঃ
সড়কের বেশিরভাগ দুর্ঘটনা গাড়ি ও যানবাহনের অতিরিক্ত ও নিয়ন্ত্রনহীন গতির জন্যই ঘটে। অনেকেই ভেবে থাকেন সড়কের বাঁকগুলিতে মনে হয় দুর্ঘটনার হার বেশি। জেনে অবাক হবেন যে, সড়কের বাঁক থেকেও সোজা পথে দুর্ঘটনার হার ঢের বেশি। সড়ক বিভাজক দিয়ে না হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ ঠেকানো যায়, কিন্তু প্রচন্ড গতিতে ওভারটেকিং এর চেষ্টায় ঘটা দুর্ঘটনা ঠেকানোর কী উপায়? এর জন্য তো নিরাপদ গতির মাত্রা নিয়ে চালকের সতর্কতা ও সচেতনতা ছাড়া আর কোন পথ নেই বলা যায়।
এছাড়াও, হাইওয়েতে যে গতিতে গাড়ি চলে, সেই একই গতি যদি শহরের ভেতরের জনবহুল রাস্তায় রাখার চেষ্টা করা হয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী। সুতরাং ড্রাইভিং এর সময় মনে রাখা জরুরী, যত বেশি গতি, তত বেশি ঝুঁকি। আপনি যদি স্টিয়ারিং হাতে ধরে বসেন, তবে ধৈর্যকে সঙ্গী বানাতেই হবে।
২. গতির নিয়ন্ত্রনঃ
অবশ্য শুধু বেশি গতি নয়, কিছু ক্ষেত্রে গতি কমানোও হতে পারে দুর্ঘটনার কারণ। কীভাবে? পেছন থেকে আসা বাহন ও তার গতির দিকে খেয়াল না করেই যদি হঠাত চলন্ত গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়া হয়, কিংবা থামিয়ে ফেলা হয় গাড়ি, তাহলেও মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। যা হতে পারে প্রাণঘাতীও। অর্থাৎ, নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য চালকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন থাকতে হবে গাড়ির গতির উপর।
৩. ড্রাইভারের অমনোযোগঃ
একটি গাড়ি ড্রাইভ করার সময় চালকের সম্পূর্ণ মনোযোগ গাড়ি ও রাস্তার উপর থাকা জরুরী। যার নেই কোন বিকল্প। এখনকার সময়ের একটি বড় সমস্যাই হচ্ছে ড্রাইভিং এর সময় ফোনের ব্যবহার। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে যদি একজন চালক ফোনে কথা বলতে থাকেন বা অন্য কাজ করতে থাকেন, তাহলে তার মস্তিষ্কের বড় অংশটি সেই ফোনে কথা বা কাজেই ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। ড্রাইভিং এর কাজে নিযুক্ত থাকে মস্তিষ্কের ছোট অংশটি। গাড়ি ড্রাইভ করার সময় মস্তিষ্কের যে হিসাব নিকাশ ও বিচার করার ক্ষমতা প্রয়োজন, সেটি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মস্তিষ্কের এই বিভাজনে। ফলাফল স্বরূপ দুর্ঘটনার ভয়ংকর ঝুঁকিতে থাকে সেই গাড়িটি।
ফোন ছাড়াও রাস্তায় অন্য মানুষ কিংবা পশুর অবাধ বিচরন, অত্যাধিক বড় ও আলোকোজ্জ্বল বিলবোর্ড, অপর পাশ থেকে আলোর বিচ্ছুরন ইত্যাদির কারনেও ড্রাইভারের মনোযোগ ব্যাহত হতে পারে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে ড্রাইভিংয়ের সময় সতর্ক থাকতে হবে এসব ব্যাপারেও।
৪. সিটবেল্টঃ
বিশ্বের নানান দেশের মতো বাংলাদেশেও এখন চলন্ত গাড়িতে সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। এমনকি এই নিয়ম না মানলে গুনতে হবে জরিমানা। সিট বেল্ট বেধে গাড়ি ড্রাইভ করা এবং গাড়িতে বসা নিরাপদ চলাচলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে সরাসরি দুর্ঘটনা রোধ করা না গেলেও, কমানো যাবে জানমালের ক্ষতির ঝুঁকি। তাই গাড়ি ড্রাইভ করার সময় গাড়ির চালক সহ যাত্রীদেরও সিটবেল্ট বাঁধার প্রতি সতর্ক হওয়া জরুরী।
৫. প্রতিযোগিতার মনোভাবঃ
সড়কপথ কোন রেসিং ট্র্যাক নয়। এই কথাটি সবাই জানলেও, মানতে ভুলে যান অনেকেই। প্রতিযোগিতা করতে চান আশে পাশের গাড়ির সাথে। কিংবা জেদ ধরে ফেলেন যে, সামনে থাকা গাড়িটিকে আমার টেক্কা দিতেই হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনাতেই শেষ হয় এই রেসের ফলাফল। ড্রাইভার নিজে হতাহত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ করেন নিজেরসহ অন্যান্য বাহন ও জানমালের। বুঝতেই পারছেন, দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে চাইলে গন্তব্যে পৌঁছানোর রাস্তায় প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ঝেড়ে ফেলতে হবে মাথা থেকে।
৬. ড্রাইভিংয়ে অদক্ষতাঃ
অনেকের ধৈর্যক্ষমতা এতোই কম যে, গাড়ি ড্রাইভিংয়ের টুকটাক জেনেই গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। গাড়ি চালনায় শতভাগ দক্ষতা অর্জন ছাড়া সড়কপথে গাড়ি নিয়ে নামার ফলাফল যে কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা বিপদে পড়ার আগ পর্যন্ত অনুভব করেন না অনেকেই। যে কোন যানবাহনের চালক নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে তাই চালকের দক্ষতার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করতে হবে গাড়ির মালিকের। এমনকি গাড়ি যদি নিজেরও হয়, তবুও সেটা চালানোর আগে অর্জন করতে হবে পরিপূর্ণ দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস।
৭. ট্রাফিক সিগনাল আইনঃ
বিশ্বজুড়েই ট্রাফিক আইন ও সংকেত মানার ব্যাপারে প্রচুর গুরুত্ব দেয়া হয়। না মানলে ব্যবস্থা আছে কঠিন শাস্তি ও জরিমানারও। সবুজ বাতিতে গাড়ি চলবে, লালে থেমে যেতে হবে, হলুদ বাতিতে অপেক্ষা করতে হবে- বিশ্বজুড়ে রাস্তায় ট্রাফিকের এই নিয়ম কার্যকর থাকলেও, বাংলাদেশে দৃশ্যপট কিছুটা ভিন্ন বলা যায়। ট্রাফিক লাইট আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা মান্য করে রাস্তায় চলার প্রচলনটা কমই এদেশে। অনেক জায়গায় তো বন্ধ কিংবা অকার্যকর হয়ে আছে লাইট। তবে লাইট কাজে না আসলেও রাস্তায় রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশরা কিন্তু যানবাহনের সুশৃঙ্খল চলাচল নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। মনে রাখতে হবে, দায়িত্ব কিন্তু শুধুই ট্রাফিক পুলিশ কিংবা সিগনাল লাইটের না। নিজের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, ড্রাইভিংয়ের সময় নিজেকেই সচেতন হতে হবে ট্রাফিক আইনগুলো নিয়ে।
যদি ট্রাফিক সিগনাল লাইট ঠিকঠাক মতো কাজ করে, তাহলে এই লাইটের নির্দেশনা মেনেই এগোতে হবে সড়কপথে। আর যদি সেই নির্দেশনার দায়িত্বে থাকে কোন ট্রাফিক পুলিশ, তবে মানতে হবে তাঁর নির্দেশনা। সিগনাল লাইট বা পুলিশের থামার নির্দেশনা অমান্য করে গাড়ি ছুটিয়ে যদি এগিয়েও যান, মনে রাখবেন, সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
কোন রাস্তায় যদি নির্ধারণ করে দেয়া থাকে গতিসীমা, মেনে চলতে হবে সেটাও। রাস্তায় সামনে কোথাও স্পিড ব্রেকার থাকলে, ইউ টার্ন, বাঁক, মসজিদ, হাসপাতাল কিংবা স্কুল থাকলেও চিহ্নিত সাইনবোর্ডের দেখা পাওয়া যায় কিছু আগে। খেয়াল রাখতে হবে সেগুলোর দিকে এবং সেই হিসেবেই গাড়ি ড্রাইভ করতে হবে।
৮. অপ্রস্তুত বাঁক নেয়াঃ
কোন রাস্তাই সোজা একভাবে চলতে থাকে না। সেখানে ডানে, বামে বাঁক, ইউটার্ন থাকবেই। অমনোযোগী ভাবে নিশ্চিন্তে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকলেন, আর সামনে হঠাত কোন বাঁক চলে এলে অপ্রস্তুত অবস্থায় হুট করে গাড়ি টার্ন করতে গেলেন। এভাবেই যে বড় বড় দুর্ঘটনাগুলি ঘটে, তা কি জানেন? আরেকটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন।
গাড়ি ইউটার্ন নিচ্ছেন, অপর পাশ থেকে গাড়ি আসছে কিনা সেদিকে খেয়াল না করেই। সেই মুহূর্তে অপর পাশ থেকে কোন গাড়ি বা বাহনও যদি তীব্র গতিতে আসতে থাকে আপনার টার্ন নেয়া অবস্থায় থাকা গাড়িটির দিকে খেয়াল না করেই? সড়কপথে এভাবে ঘটা দুর্ঘটনার সংখ্যাও নেহায়েত কম না। তাই ড্রাইভিংয়ের সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে চাইলে, রাস্তার বাঁক, ইউটার্ন গুলি দেখে শুনে খুব সাবধানে এবং যথাসময়ে গাড়ির ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে অপরকে সতর্ক করে তবেই পার করতে হবে। একই পরামর্শ রাস্তায় লেন পরিবর্তন করার ক্ষেত্রেও।
৯. উলটো দিকে ড্রাইভঃ
ঘুরে ফিরে আবারো রাস্তায় ড্রাইভিংয়ের সাথে ধৈর্যর সম্পর্কের কথা চলেই আসলো। অনেক সময় দেখা যায়, কারো গন্তব্য খুব কাছাকাছি, কিন্তু সেটা রাস্তার অপর পাশে। সেখানে পৌঁছাতে হলে বেশ কিছুদূর ড্রাইভ করে এগিয়ে গিয়ে ইউটার্ন নিয়ে ফিরে আসতে হবে। এই রাস্তাটুকু পার করতেই ধৈর্যে কুলায় না অনেকের। জীবন বাজি রেখেই ‘রং ওয়ে’ কিংবা উলটো পথ ধরে ড্রাইভ করতে করতে এগিয়ে যান। এভাবে ঘটে প্রচুর দুর্ঘটনা। এমন অধৈর্য গাড়ির চালকের ভুলের খেসারত তার পাশাপাশি দিতে হয় সঠিক পথে চলা কোন বাহনকেও। তাই রাস্তায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে চাইলে উলটো দিকে গাড়ি চালানোর চিন্তা মাথায় আনা যাবে না। ইউটার্ন যতই দূরে হোক, ধৈর্য ধরে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সেই পথেই।
১০. গাড়ির ফিটনেস ও সক্ষমতাঃ
রাস্তায় যদি নিরাপদে থাকতে চান, তবে আগে নিরাপদে রাখুন আপনার গাড়িটিকে। গাড়ির নিয়মিত সার্ভিসিং, কারিগরি ত্রুটি, টায়ার, ব্যাটারি, ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা ইত্যাদির দিকে যদি খেয়াল না রাখেন, তাহলেও বিপদে পড়তে হতে পারে চলন্ত রাস্তায়। তাই অবশ্যই খেয়াল রাখুন, অন্তত গাড়ির ফিটনেস বা কারিগরি কোন ত্রুটির কারনে যেন সড়কপথে কোন বিপদের সম্মুখীন হতে না হয়। আমাদের দেশে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকে সুযোগ খোজেন, কীভাবে ত্রুটিপূর্ণ গাড়িকেও ফিট দেখিয়ে রাস্তায় নামাবেন। কোনভাবে সুযোগের অপব্যবহার করে কেউ হয়তো কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে রাস্তায় নামিয়েও ফেলেন গাড়ি। তবে তারা এটা চিন্তা করেন না যে, নিজের হাতেই কতটা ঝুঁকিতে ফেলে দিলেন গাড়ি ও গাড়ির ব্যবহারকারীদের।
সড়কে দুর্ঘটনা আগেও ছিলো, এখনো আছে, দুর্ভাগ্যবশত মানুষের সচেতনতার অভাবে ভবিষ্যতেও থেকে যাবে। তবে এটা প্রতি বছর বেড়ে চলার যে হার তা খুবই চিন্তার কারণ। নিজেদের সামান্য সচেতনতা ও সতর্কতা দিয়ে আমরাই কিন্তু পারি সড়কপথের এমন ভয়ংকর সব দুর্ঘটনা ও হতাহতের হার কমিয়ে আনার চেষ্টা অন্তত করতে। যে ৭টি উপায়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব তা সম্পর্কে জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়তে পারেন।
শেষকথা
আমরা আসলে দুর্ঘটনার তালিকায় আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর মুখ দেখতে চাই না। আমাদের ড্রাইভিং সিটে বসার পর থেকে প্রতিটি ব্রেকের ফলাফল যেন খুব বুঝে শুনে নেওয়া হয়। সুস্থ এবং ভালো থাক, প্রতিটি মানুষ। শখের গাড়িগুলো না হোক অকাল মৃত্যুর কারণ। আপনার আগামীর ভ্রমণ শুভ হোক।