মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব। আর এই যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ানো গাড়িগুলো এখন জাদুঘরের কাঁচের দেয়ালে বা মোটা শিকলে আবদ্ধ থাকে। যে গাড়িগুলো আমাদের দেশকে জয়ী করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সেগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে সযত্নে কারণ এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের চিহ্ন বহন করে । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গাড়ি নিয়ে কখনো চিন্তা করে দেখেছেন কি? এই গাড়িগুলো আমাদের দেশকে প্রতিপক্ষের সাথে মোকাবেলায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কাইজার উইলিজ জীপ ওয়াগনার
মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল ওসমানি এই গাড়িটি ব্যবহার করতেন। যশোর শিক্ষাবোর্ডের সৌজন্যে তিনি এই গাড়িটি পেয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় এই গাড়িটিতে গোলাবারুদ আনা নেওয়ার কাজও ব্যবহৃত হয়েছিল। এছাড়া এই গাড়িটিতে করে বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের কাজও করা হত।
নীল রংয়ের বিশাল এই জীপগাড়িতে একসঙ্গে ৫/৬ জন বসা যেত। গাড়িটি ছিল প্রায় ১/৪ টনের। গাড়ির নাম্বার ছিল যশোর ব-১৪৬।
গাড়িটি এখন বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরে রাখা আছে।
মুক্তিযুদ্ধের গাড়ি বহরে মার্সিডিস বেঞ্জ
এই গাড়িটি ব্যবহার করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ডিভিশন ১৪ এর জিওসি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর কাছ থেকে এই গাড়িটি উদ্ধার করা হয়। পরে এই গাড়িটি সাবেক সেনাপ্রধান, লেঃ জিয়াউর রহমান ব্যবহার করতেন।
কালো রংয়ের দেখতে চমৎকার এই গাড়িটি ছিল জার্মানির তৈরি। ৪০০০ সিসির ও ৪ সিলিন্ডার বিশিষ্ট এই গাড়ির নাম্বার ছিল ০০০০০৫।
গাড়িটি বর্তমানে বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘরে রাখা আছে।
লাল জীপ
লাল রংয়ের জীপ গাড়িটি ছিল তৎকালীন মহকুমা জেলা প্রশাসকের জন্য বরাদ্দ । ১৯৭১ সালে জনাব আকবর আলি খান ছিলেন মহকুমার দায়িত্বে । তিনি যুদ্ধ চলাকালীন ট্রেজারের চাবি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের হাতে তুলে দেন। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চাবি নিয়ে অস্ত্র সহ এই গাড়িটিও নিজেদের কাজে ব্যবহারের জন্য নিয়ে নেন । এই জীপটি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হত। এছাড়া অস্ত্র , গোলাবারুদ ইত্যাদি আনা নেওয়ার কাজেও ব্যবহৃত হত।
এই গাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের স্মারক হিসেবে সংরক্ষন করা হয়। অনেকেই এই গাড়িটিকে নিয়ে সংরক্ষনের ব্যাপারে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। গাড়িটির অবস্থা জীর্ণশীর্ণ প্রায়। গাড়ির সংরক্ষণের জন্য কিছু অর্থ প্রদান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
গাড়িটি এখন জেলা প্রশাসকের অফিসে দোতালার ছাদে রাখা আছে।
ডায়মন্ড টি
এই ট্রাকটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। গাড়িটি যুদ্ধের সময় খাবার আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হত। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের পর গাড়িটি পাকবাহিনীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। গাড়ির নাম্বার ছিল ১৮৬৯৯০।
জীপ অ্যাম্বুলেন্স
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে এই জীপ অ্যাম্বুলেন্সটি তৈরি করা হয় । এই গাড়িটি মুলত আহত সৈন্যদের দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হত। ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশে বিভিন্ন ইউনিটে এই জীপটি ব্যবহার করা হয়েছিল । এই অ্যাম্বুলেন্স জীপের মডেল হচ্ছে ওসিজে-৪।
শেভ্রলে ডিলাক্স
চট্টগ্রামের বন বিভাগ তখন এই গাড়িটি ব্যবহার করতো। এই গাড়িটিতে বিখ্যাত ব্যক্তিগনও ভ্রমণ করেছেন। পূর্ব বাংলা সফরে এসে, গাড়িটি ব্যবহার করেছিলেন আইয়ুব খান। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর চট্টগ্রামে সফরে যেয়ে, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই গাড়িতে ভ্রমণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গাড়ি শেভ্রলে ডিলাক্স এর নাম্বার প্লেট হচ্ছে ক-২১৩৩।
ট্যাংক পিটি ৭৬
ট্যাংক পিটি হচ্ছে রাশিয়ার তৈরি । এই গাড়িটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। গাড়িটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই ট্যাংকটি পানিতেও চলতে পারে।
ট্র্যাক কার্গো
ট্র্যাক কার্গো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। সাধারণত যুদ্ধের কাজেই ব্যবহার করা হত এই গাড়িটি । যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি এই গাড়িতে সংযুক্ত থাকত যেমন- অস্ত্র, রেডিও ইত্যাদি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর কাছ থেকে এই গাড়িটি উদ্ধার করা হয়। এই গাড়ির মডেল হচ্ছে ভ্যান মডেল এম ১০৯।
ওল্ডসমোবিল
যুদ্ধের আগে এই ওল্ডসমোবিল গাড়িটি মার্কিন দূতাবাসে ব্যবহার করা হত। এরপর ফরিদপুরের একজন হিন্দু ব্যবসায়ী গাড়িটি কিনে নেন। যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন পাকবাহিনী হিন্দু বলে তাকে খুঁজতে শুরু করেন ,তাকে না পেয়ে তার গাড়িতে গুলি করে, সেই গুলির দাগ এখনও গাড়ির গায়ে রয়ে গিয়েছে।
রিকয়েললেস রাইফেল ট্যাংক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই বিধ্বংসী গাড়িটি তৈরি করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর থেকে গাড়িটিকে উদ্ধার করা হয়।
মিডিয়াম যান
এই গাড়িটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। এই গাড়িটি অনেক শক্তিশালী। এই গাড়ির মাধ্যমে ওজনে ভারী যানবাহন অনেক সজেই সরিয়ে ফেলা এবং একস্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রায় ৫.০৮ মন বস্তু অপসারণের ক্ষমতা আছে এই যানটির। এই যানটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর কাছ থেকে উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এই যানটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যবহার করেছে।
৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জন্য গর্বের বিষয়, আর এই মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত সবকিছু সংরক্ষণ করা সবারই দায়িত্ব। আর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এসব গাড়ি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি বহন করে। কিছু মুক্তিযুদ্ধের গাড়ি হয়ত সংরক্ষন করা হয়েছে কিন্তু বেশিরভাগ গাড়িই সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট প্রায়। সরকার বা ব্যাক্তিগত উদ্যেগে যদি সবাই এই গাড়িগুলো সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালায় তাহলে হয়ত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিছু হলেও দেখবে, জানবে।