প্রথমেই নারী দিবসে বিশ্বের সকল নারীকে জানাই নারী দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। একজন নারী তার ঘরে রানী এবং বাইরে যোদ্ধা। একজন নারী গর্ভধারিণী, প্রেয়সী, জননী এবং মমতাময়ী । ইতিহাস ঘাটলে দেখতে পাওয়া যায় কত নারী কত মহৎ কাজ করে ইতিহাসের পাতায় তাদের গৌরবোজ্জ্বল নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে যেতে পেরেছিলেন । বিখ্যাত মনের অধিকারিণী মাদার টেরিসা, সেবিকা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি এবং আজকে আমরা যার গল্প বলছি তিনি আর কেউ নন বিখ্যাত অটোমোবাইল উদ্ভাবনকারী কার্ল বেঞ্জের সহধর্মিণী এবং বিশ্বের প্রথম নারী গাড়ি চালক বার্থা বেঞ্জ । বার্থা বেঞ্জ ছিলেন বিশ্বের প্রথম গাড়ির যাত্রী, চালক এবং বিশ্বের প্রথম গাড়ির প্রস্তুতকারী সহকারী । এবং মজার ব্যাপার হলো তিনি প্রথম মুচির দোকানে গাড়ি নিয়ে ব্রেক শু ঠিক করান আর ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম গাড়ির মেরামত ।
এক নজরে বার্থা বেঞ্জ
নাম – বার্থা বেঞ্জ ।
জন্ম -১৮৪৯ সাল।
জন্মস্থান – জার্মানির ফোরজেইম শহরে এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
বিয়ে – ২৩ বছর বয়সে , ১৮৭২ সালে কার্ল বেঞ্জের সাথে তার বিয়ে হয় ।
সন্তান- বেঞ্জ দম্পত্তির দুইজন সন্তান ছিল।
অভিজ্ঞতা- বার্থা বেঞ্জ বিশ্বের প্রথম নারী গাড়ি চালক এবং কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই উচুনিচু পথে টানা ১৫ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে সক্ষম হন তিনি।
মৃত্যু- ১৯৮৮ সালে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বার্থা বেঞ্জ ।
বিশ্বের প্রথম গাড়ি চালক বার্থা বেঞ্জ
কার্ল বেঞ্জ যখন প্রথম ঘোড়া ছাড়া কোন পেট্রোল চালিত গাড়ি উদ্ভাবন করেন তখন বার্থা বেঞ্জ গাড়িটি প্রথম চালান। তিনি গাড়িটি ৬৬ মাইল চালান এবং এটি ছিল বিশ্বের প্রথম গাড়ি চালকের গল্প। পরবর্তীতে তাকে নিয়ে নির্মিত হয় একটি সিনেমা।
দুঃসাহসী এক অভিযানে বার্থা
মেয়েমানুষ বলতেই বিয়ে, সংসার, পিত্রালয় ছেড়ে স্বামী সন্তান নিয়ে থাকা । আর পিত্রালয়ের জন্য সারাক্ষন অস্থির হয়ে ছটফট করতে থাকা। সেই আদিমযুগ থেকেই চলে আসছে এই নিয়ম। বার্থা বেঞ্জ তার ক্ষেত্রেও এর বিপরীত কিছু হয়নি। বিয়ের পর মাঝে মাঝেই বাবার বাড়িতে ছুটে ছুটে চলে যেতেন তিনি। একবার তিনি স্বামীকে না জানিয়ে ১৩ ও ১৫ বছর বয়সী দুই সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। আর সঙ্গে নেন স্বামীর সদ্য তৈরি তিন চাকার মডেল-৩ গাড়িটি । বেঞ্জের জন্য একটি চিঠি রেখে যান অবশ্য। কিন্তু সেসময়য়ে গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তা খুব একটা উপযোগী ছিল না। পথে কোন পেট্রোল স্টেশন বা ওয়ার্কশপ ছিল না । এমনকি এই গাড়ি নিয়ে সাথে দুই সন্তান সহ কতটুকু চলতে পারবেন সেই বিষয়েও তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। যাত্রাপথে শুরু হয় নানা বিপত্তি – ইঞ্জিন গরম হয়ে যাওয়া ,পেট্রোল শেষ হয়ে যাওয়া , ব্রেক শু খয়ে যাওয়া ইত্যাদি । ইঞ্জিন ঠাণ্ডা রাখার জন্য বার্থার সন্তানদের মাঝপথে নেমে পানির সন্ধান করতে হয়েছিল ও পানি আনতে হয়েছিল ইঞ্জিনে ঢালার জন্য । পেট্রোল শেষ হয়ে গেলে তিনি পথে ফার্মেসি থেকে বেনজেইন কেনেন। ইঞ্জিনে যে জায়গা দিয়ে তেল সরবরাহ করে সে জায়গায় ময়লা জমে আটকে গেলে বার্থা বেঞ্জ তার হ্যাট থেকে একটি পিন খুলে নিয়ে জায়গাটি পরিষ্কার করে নেন। ইঞ্জিনের একটি তার বার বার উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছিল বার্থা তখন তার মোজার রাবার দিয়ে সেটাও ঠিক করে ফেলেন।
তখন গাড়ির এত সমস্যার চটজলদি সমাধান দেওয়াও ছিল প্রথম, কাজেই বার্থাকে প্রথম গাড়ি মেকানিকও বলা হয়ে থাকে। অবশেষে সব বাঁধা অতিক্রম করে তারা পৌঁছেছিলেন গন্তব্যে। এই ঘটনার পর বেঞ্জ মিউখীনে গাড়ির একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন । তার সেই প্রদর্শনী এত বেশী জনপ্রিয় হয় যে বেঞ্জ দম্পত্তি গোল্ড মেডেল অর্জন করেন।
বেঞ্জ দম্পত্তি নির্মিত প্রতিষ্ঠান আজকের মার্সিডিস বেঞ্জ। বার্থা বেঞ্জ ও তার সেই দুঃসাহসিক অভিযানের কারনে বাণিজ্যিকভাবে সফল গাড়িটি সবার নজরে আসে। বেঞ্জ গাড়ির সফলতা শুধু একা কার্ল বেঞ্জের না, বার্থা বেঞ্জেরও সমান অর্জন ছিল।
বার্থার সহযোগিতা আর পরিশ্রম
তৎকালীন সময়ে জার্মানের আইনে কোন বিবাহিতা নারী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারতেন না। বিয়ের আগে বার্থা বেঞ্জ কার্ল বেঞ্জকে আর্থিকভাবে অনেক সহযোগিতা করতেন এবং বিয়ের সময়েও যৌতুক হিসেবে দেন অর্থ।যাতে বেঞ্জ তার গাড়ি উদ্ভাবন আর প্রস্তুতের খরচ চালাতে পারেন। আর শুধু আর্থিকভাবেই না সবসময় তিনি একজন সহধর্মিণী হবার পুরো দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। বেঞ্জকে তার গাড়ি তৈরির জন্য অনেক ধরনের উপদেশ দিতেন । তার মধ্যে একটি উপদেশ ছিল, গাড়ি নিচু গিয়ারে ভালো চলবে এবং ব্রেকের জন্য কোন আবরন তৈরি করার জন্য উপদেশ দেন বার্থা বেঞ্জ । তার উপদেশ মেনে বেঞ্জ গাড়ির ভেতর অনেক ধরনের পরিবর্তন ও উন্নয়ন করেন।
মানুষ আগে ভাবত অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি শুধু পুরুষদের কাজের জায়গা এবং পুরুষরাই শুধু অটোমোবাইল জগত রাজত্ব করে চলবে। কিন্তু বার্থা বেঞ্জ সেই ইতিহাসের পাতায়ই উল্টে দিয়েছিলেন । এখনো অটোমোবাইল জগতে নারীকে খুব বেশী জড়িত থাকতে দেখা যায় না। কিন্তু বিজ্ঞান , সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প, প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য সবকিছুতেই আমরা দেখেছি নারীর বিচরণ। ছুটে চলার এই অদম্য পথে নারী হোক সর্বজয়ী। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা সেই ‘নারী’ কবিতার বিখ্যাত লাইন দুটো দিয়ে শেষ করছি আজকের নারী দিবসের লেখাটি।
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর “