বেশি না, বিগত ২ দশক আগের কথা ভেবে দেখুন, তখন কমার্শিয়াল কোম্পানিগুলো ফ্লিট ম্যানেজমেন্টের জন্য কাগজের মানচিত্রের উপর নির্ভরশীল ছিলো। পথের সঠিক নির্দেশনা অফিসে বসে পন্য পরিবহণের রুট মনিটর করার জন্য, প্রতিটি যানবাহনেই এই মানচিত্রগুলো থাকত। প্রযুক্তির বিবর্তনের ফলে পুরো ফ্লিট ম্যানেজমেন্টটি এখন ফ্লিট ট্র্যাকিং প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কাগজের মানচিত্র ছেড়ে, কমার্শিয়াল গাড়ি ট্র্যাকিং এখন জায়গা করে নিয়েছে আপনার পকেটে থাকা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। শুধু যে গাড়ি মনিটর করা যায় তা নয়, দিন শেষে যানবাহন ও পরিবহণ সম্পর্কিত সব তথ্য অটোম্যাটিক রিপোর্ট আকারে জানিয়ে দিচ্ছে একজন ট্রান্সপোর্ট/ফ্লিট ম্যানেজার বা অফিস অ্যাডমিনকে।
ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট কী কাজ করে?
দুই দশক আগে তো দূরের ব্যাপার, গত অর্ধযুগ আগেও ফ্লিট ট্র্যাকিং প্রযুক্তি বলতে সাধারণ মানুষের হাতে তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তিগত উন্নতির শীর্ষে এসে টেলিমেটিক্স, জিপিএস নেভিগেশন, এবং ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারগুলো, কমার্শিয়াল কোম্পানিগুলোর ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট সেক্টরে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এই প্রযুক্তির সবচাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে, এর মাধ্যমে আনায়াসেই নির্ভুল ও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। ২০০০ সাল এত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে যে, জিপিএস ট্র্যাকিং এখন আরো বেশি নিখুঁত তথ্য দিয়ে থাকে। এখন থেকে আপনিও ফ্লিট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে আপনার প্রতিষ্ঠানের সব কাজের নির্ধারিত সময়, ট্রাফিক, আবহাওয়া, কর্মচারীর কাজ সহ আর অনেক কিছুর খেয়াল রাখতে পারেন। ফ্লিট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে আপনি আপনার কর্মচারীর নির্ধারিত কাজের বাস্তব ও সঠিক তথ্য দেখতে পারবেন। উৎপাদনে খরচ কমানো থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতিও ফ্লিট ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
কীভাবে বিগত ১০ বছরে কীভাবে ‘ফ্লিট ট্র্যাকিং ম্যানেজমেন্ট’ আমূল পরিবর্তন করেছে ?
একবিংশ শতাব্দীর একেবারে জন্মলগ্ন থেকে মার্কিন সামরিক বাহিনী তাদের যুদ্ধযান বহরে ফ্লিট ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। তারও আগে, ১৯৯৬ সালে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই জিপিএস সিস্টেমের সুবিধা সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি প্রত্যেক সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি পৌঁছে দিতে চান । একই দশকে www (ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব) প্রকাশ পায়। এবং কম্পিউটার নির্ভর সব ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট গুলো ওয়েব-নির্ভর হতে শুরু করে।
২১-শতাব্দীর দিকে তাকালে দেখা যাবে, মেশিন টু মেশিনে কমিউনিকেশন ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে, জিপিএস ট্র্যাকিং ও ইন্টারনেট ব্যবস্থার সমন্বয়ে ফ্লিট ম্যানেজমেন্টের তথ্য গ্রহন আরো নির্ভুল হয়ে উঠেছে। এর সাথে সাথে উন্নত হয়েছে ক্লাউন্ড ভিত্তিক প্রযুক্তি এবং সেনসর প্যারামিটার। ২০০৬ সালে সর্বশেষ জিপিএস স্যাটালাইট ক্লাউড ভিত্তিক প্রযুক্তি নিয়ে এবং সেন্সর প্যারামিটার সহ নতুন করে চালু করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জিপিএস সেবা সরবরাহ শুরু হয় ।
মোবাইল ফোন আর ট্যাব জিপিএস নেভিগেশন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আরো বেশী উন্নত হয়ে ওঠে। তখন থেকেই মোবাইল ফোনে অ্যাপস ইন্সটলের মাধ্যমে জিপিএস নেভিগেশন ও ট্র্যাকিং এর ব্যবহার করা শুরু হয়। যার ফলে, জিপিএস, ক্লাউড কম্পিউটিং, উচ্চ গতি সম্পন্ন ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষমতা, টেলিমেটিক্স ইত্যাদি ফোনের মাধ্যমে ব্যবহার করে, কমার্শিয়াল কোম্পানির এইচ আর/ ফ্লিট ম্যানেজাররা তাদের সব গাড়ির নিখুঁত এবং বাস্তবিক তথ্য পেতে শুরু করে। প্রাতিষ্ঠানিক যানবাহনগুলো, ড্যাশবোর্ডে কম্পিউটারাইজড সিস্টেম চালু করে। ফলে যোগাযোগ হয়ে ওঠে আরো সহজ। ইন-ক্যাব বা ওয়েব কানেক্টেড প্রযুক্তির মাধ্যমে ম্যানেজারদের সাথে গাড়ির চালকগন তাদের সব সময় সংযুক্ত থাকতে পারে। একই সাথে, জিপিএস ভিত্তিক ফ্লিট টেলিমেটিক্স প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ,১০০০ মাইল দূর থেকেও গাড়ির চালকের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায় এবং যেকোনো মালবাহী যানের অবস্থানও জানা যায়।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন এই প্রক্রিয়াটি প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন, FMCSA প্রতিষ্ঠানের পক্ষ্ম থেকে একটি নির্দেশ জারি হয় যে, ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ, প্রাতিষ্ঠানিক সকল যানবাহনকে কাগজের লগের পরিবর্তে ইলেক্ট্রিক্যাল লগ ব্যবহার করতে হবে। এই নীতি কার্যকর করার জন্য সবচাইতে বেশি সাহায্য করেছে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং ফ্লিট ম্যানেজারদের নির্ভুল তথ্য সংরক্ষণের সুযোগ দিয়েছে।
সময় বাঁচায় ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট
রাস্তার মধ্যে হঠাৎ যানবাহনের কোন অংশ ভেঙ্গে গেলে / নষ্ট হয়ে গেলে, তা একজন ট্রাক চালক, পণ্য প্রেরণকারী বা কাস্টমারের জন্য অনেক বেশী বিরক্তিকর ব্যাপার এবং এতে কালক্ষেপণও হয় অনেক। উন্নত ফ্লিট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে ম্যানেজারকে আগে থেকেই গাড়ির নির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে তথ্য এবং গাড়ির বডির ও গাড়িটি কতটুক চলতে পারবে তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ একটি তথ্য দেয়া হয়। ফ্লিট ট্র্যাকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্তমানে গাড়ির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাওয়া যায়। যেমন – ব্রেক, লাইট, টায়ার ইত্যাদি। এবং কোথাও যাওয়ার আগে গাড়ির নির্দিষ্ট যন্ত্রাংশ গুলো ঠিকঠাক মত কাজ করছে কিনা তাও জানা যাবে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার হল, ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে গাড়ির অবস্থা, দুর্ঘটনা বা জরুরী ব্যাপার সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে একজন ফ্লিট ম্যানেজার জানতে পারেন ।
জ্বালানী ব্যবহার নিয়ন্ত্রন (ফুয়েল মনিটরিং)
টেলিমেটিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফ্লিট ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। টেলিমেটিক প্রযুক্তি যানবাহন চালকদের সব তথ্য ও গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে তার গতিবধি ও অভ্যাস সম্পর্কে একটি সামগ্রিক তথ্যচিত্র দেয়। আর অতিরিক্ত গতি সম্পর্কে তথ্য ম্যানেজারকে জানিয়ে দেওয়া হয়। চালকদের এলোপাথাড়ি গাড়ি চালানো ও জ্বালানি খরচ কমিয়ে কীভাবে গাড়ি চালাতে হয় তার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যপারে পরামর্শ দেওয়া হয়। এইসব তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে গড়ে প্রত্যেক বছর প্রায় ১০-১৫% জ্বালানি খরচ কমানো গিয়েছে।
কর্মচারী (ড্রাইভার) নজরদারি
চালকদের গাড়ি চালানোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ছাড়াও, ফ্লিট ট্র্যাকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে একজন ফ্লিট ম্যানেজার তার অদীনে থাকা গাড়িগুলোর রুট নির্ণয়ে পরিকল্পনা করার সুযোগ দিচ্ছে। যানবাহন কখন/ কোথায় প্রেরণ করা হবে, কীভাবে প্রেরন করা হবে, চালকের দক্ষতা ও সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং মূল্যায়ন সুনিশ্চিত করছে । কর্মীদের শিফট নির্ধারণ ও কাজের নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করে দিচ্ছে ভেইকেল ট্র্যাকার বা ফ্লিট ম্যানেজম্যান্ট প্রযুক্তি। ড্রাইভার কত ঘণ্টা কাজ করছে, কর্মীদের সাথে সহজভাবে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ এবং এরকম আরো অনেক কিছু ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজারদের জন্য সহজ করে দিচ্ছে ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট । এভাবেই একজন ফ্লিট ম্যানেজার তার যানবাহনগুলোর গতিবিধ ও দক্ষতা নজরদারির মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠানের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
গাড়ি ও পণ্য চুরি রোধে ফ্লিট ট্র্যাকিং
সাধারণত যে প্রতিষ্ঠান অনেক যানবাহন ব্যবহার করে, সে যানবাহনগুলোই চোরদের নজরে পড়ে বেশি। যানবাহন চুরি ছাড়াও মালবাহী যানবাহনে চুরি ও জ্বালানি চুরির অনেক ঘটনাও ঘটেছে এবং ঘটছে। এসব কারনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বছরে লক্ষ-কোটি টাকার ক্ষতি গুনতে হয়। এসব সমস্যার সমাধান দিতে ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট যানবাহনের দরজায় লক আর আনলক সিস্টেমটি চালু করে । এছাড়া যানবাহনের ইঞ্জিন অন/অফ নিয়ন্ত্রণ,জরুরী বাটনের মাধ্যমে সিকিউরিটি অ্যালার্টের ব্যবস্থাও করা হয় এই ফ্লিট ম্যানেজমেন্টে।
লাভের পরিমান বৃদ্ধি।
টেলিমেটিক্স সবথেকে বেশী ইতিবাচক প্রভাব ফেলে কোম্পানির আয় বা লাভের উপর। কোম্পানির ফ্লিটে বা গাড়িগুলোতে ভেইকেল ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ কমিয়ে, লাভের পরিমান বৃদ্ধি করে। টেলিমেটিক্সের মাধ্যমে যানবাহনকে আগের থেকে আরো বেশী সুরক্ষিত রাখা যায়, যানবাহনের ইনস্যুরেন্স খরচ কমিয়ে ফেলা যায়, যানবাহনগুলোর কর্ম দক্ষতার বৃদ্ধি করা হয়। টাইম ম্যানেজম্যান্ট সহজ হয় বলে কোন যানবাহনকে অলস পড়ে থাকতে হয় না। ফুয়েল মনিটরিং এর মাধ্যমে জ্বালানি খরচ কমানো হয় এবং আরো অনেক কিছু। সময়ের প্রকৃত হিসাব রাখার মাধ্যমে, একজন ফ্লিট ম্যানেজার ভালোভাবে তার কাজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে এবং সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে ।
ফ্লিট ম্যানেজমেন্টের ভবিষ্যৎ।
ভবিষ্যতে ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট কি করবে তা সম্পর্কে অনেকেরই সীমাহীন কৌতূহল । এবছরের শুরুতে, ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ জিপিএস প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য ডক্টর ব্রাডফোর্ড পার্কিনসন এবং প্রফেসর জেমস স্পিলকার জুনিয়র, হুগো ফিওরোহাফ এবং রিচার্ড শোয়ার্জকে পুরস্কার প্রদান করেন।
এই প্রযুক্তির দ্রুত বিবর্তন এবং তথ্যের সঠিকতার কারনে এর চাহিদা বৃদ্ধি পাছে । ভবিষ্যতে মোবাইল ফোনের দক্ষতা বৃদ্ধিতেও ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট অগ্রনী ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখা যায় ।বাংলাদেশেও বর্তমানে ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট অনেক পরিচিতি লাভ করেছে। অনেকগুলো ট্র্যাকিং সার্ভিস বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত গাড়ির নিরাপত্তায় ভেহিকেল ট্র্যাকিং সার্ভিস সরবরাহ করে থাকে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘প্রহরী’ বাংলাদেশে ভেহিকেল ট্র্যাকিং সিস্টেমগুলোর মধ্যে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রহরী সম্পর্কে জানতে লগ ইন করুন আমাদের প্রহরী ওয়েব সাইটে অথবা ফোন করুন আমাদের সরবরাহিত নম্বরে।