Written By: Tanzina Ferdous
“ফেরারি”- নামটি শুনলেই চোখে ভাসে গতি আর সৌন্দর্যের এক চমৎকার যুগলবন্দী! গাড়ি প্রেমী মানুষের কাঙ্খিত একটি শব্দ ফেরারি । মানুষের হৃদস্পন্দন কেড়ে নেয় এর ইঞ্জিনের গর্জন আর আভিজাত্য। উনিশ শতকে গাড়ি আবিষ্কারের পর তখনকার গাড়ির জগতে এক বিপ্লব নিয়ে আসে ফেরারি। হাজারো মানুষের স্বপ্নের এই গাড়ির শুরুর পেছনে ছিলেন রেস পাগল এক মানুষ এঞ্জো ফেরারি।
স্বপ্নের শুরু
এঞ্জোর জন্ম ১৮৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ইতালির মদেনা শহরে। এঞ্জোর বাবা আলফ্রেডো ফেরারি যিনি ছিলেন ইতালির মদেনা শহরের একজন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। আলফ্রেডো লোহার জিনিস তৈরি এবং রঙ করার কাজ করতেন। এছাড়াও গাড়ির বিভিন্ন মেরামতেরও কাজ করতেন তিনি। ছোট ছেলে এঞ্জো মাঝে মাঝে তার সাথে কাজ করতেন।এঞ্জোর ড্রাইভিং এর হাতেখড়ি তার বাবা আলফ্রেডোর কাছেই। ১৯০৮ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে কার রেস ‘circuito di Bologna’ দেখার পরই তিনি তার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে নেন। এরপরই একজন রেস ড্রাইভার হওয়ার জন্য তাঁর অধ্যাবসায় শুরু হয়। তিনি গাড়ির বিভিন্ন কাজ শেখার চেষ্টা করেন এবং ড্রাইভ করার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরই রেস ড্রাইভার হিসিবে কাজ খুঁজতে থাকেন।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর এঞ্জো ইতালিয়ান মিলিটারিতে ১বছর লোহার জিনিসপত্র তৈরির কাজ করেন। ১৯১৮ সালে তিনি মিলিটারিদের পুরনো গাড়ির চেসিস তুরিন থেকে মিলানে নিয়ে যাওয়ার কাজ পান। যা ছিল তাঁর রেসড্রাইভার হওয়ার স্বপ্ন পুরনের পথে একটি বড় ধাপ। এখানে এসে তিনি বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ার এবং রেসড্রাইভারদের সাথে পরিচিত হন। এরপরই তিনি প্রথম রেসে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান। এর আগে তিনি কিছুদিন টেস্টড্রাইভার হিসিবে ‘Costruzioni Meccaniche Nazionali’ নামের মিলানের একটি গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
১৯১৯ সালের ৫ অক্টোবর জীবনের প্রথম রেসে অংশ নেন তিনি। এটি ছিল পাহাড়ি রাস্তার একটি রেসিং প্রতিযোগিতা। এখানে তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ১৯২০ সালে তিনি আলফা রোমিও তে রেসড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ পান।
যেভাবে এলো ফেরারির লগো
১৯২৩ সালে এঞ্জো ‘সারকুতো দেল সাভিও’ নামে একটি রেসে জয়ী হন যা ছিল ঐ সময়ে ইতালির সবচেয়ে কঠিন একটি রেসিং ট্র্যাক। ঐ রেসে অর্থপ্রদানকারী একজন কাউন্ট ছিলেন এনরিকো বারাকা। যিনি এঞ্জোর প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাঁর ছেলে ফ্র্যানসিস্কো বারাকার (যিনি ছিলেন তখনকার টপ রাঙ্ক জেট ফাইটার রেসার) জেট ফাইটার বিমানে ব্যবহৃত ঘোড়ার ছবিটি সহ একটি মেডেল উপহার দেন। যা অফিসিয়াল লোগো হিসেবে গাড়িতে ব্যবহার করা হয়।
স্কুডেরিয়া ফেরারি গঠন
১৯২৩ সালের পর থেকে এঞ্জো বেশ কিছু বড় রেস প্রতিযোগিতায় জয়ী হন। এর মধ্যে ‘Coppa Acerbo’ ছিল অন্যতম যা তাঁকে আলফা রোমিও থেকে আরো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়। ১৯২৫ সালে গ্র্যান্ড প্রিক্স মোটর রেসিং চ্যাম্পিয়ন অ্যান্টনিও এর আকস্মিক মৃত্যু এবং ১৯৩২ সালে ছেলে দিনো জন্মের পর এঞ্জো মোটর রেসিং থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং আলফার রেসিংকারের উন্নয়নে মনোযোগী হন। এরমধ্যেই ১৯২৯ সালে তিনি বিভিন্ন সুপারস্টার ড্রাইভারদের নিয়ে ‘স্কুডেরিয়া ফেরারি’ নামে তাঁর নিজস্ব রেস টিম গঠন করেন। এই টিম আলফার হয়ে বিভিন্ন রেস এ অংশ নিত। ফ্র্যানসিস্কো বারাকার স্মরণে, এঞ্জো বারাকার দেয়া মেডেলটিতে থাকা উদ্ধত কালো ঘোড়ার ছবিটি তাঁর রেসিং টিমের গাড়িতে ব্যবহার করেন। যা পরে বিখ্যাত কোম্পানির লোগো হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জার্মান রেসিং কারের যুগে তাঁর তৈরি রেসিং কারের দক্ষতা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।
১৯৩৮ সালে ফেরারি স্কুডেরিয়া ছেড়ে আলফাতে ম্যানাজার হিসেবে ১বছর কাজ করেন। ১৯৩৯ সালে ফেরারি আলফা ছেড়ে দেন এবং ‘অটো অ্যাভিও কস্তুজিও’ নামে রেসিং কারের পার্টস সাপ্লাইয়ের একটি কোম্পানি তৈরি করেন। আলফা থেকে তাঁর উপর শর্ত ছিল তিনি চার বছর রেসিং এবং কার ডিজাইনের কোন কাজ করতে পারবেন না।
ফেরারি কোম্পানির শুরু
১৯৪০ সালে ফেরারি তাঁর কোম্পানি থেকে প্রথম রেসিংকার তৈরি করেন যার মডেল ছিল AAC 815, যদিও এটিকে ফেরারি মডেলের গাড়ি হিসেবে ধরা হয়না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেরারি মদেনা থেকে মেরেনিলো শহরে চলে যান এবং ১৯৪৭ সালে নিজের নামে রেসিংকার তৈরির কোম্পানি শুরু করেন। আর এখান থেকেই ফেরারি গাড়ির যাত্রা শুরু হয়। প্রথম ফেরারি মডেলের গাড়িটি ঐ সালেই তৈরি হয় যার মডেল ছিল 125 S. এই গাড়িটিতে ব্যবহার করা হয় ছয় সিলিন্ডারের ‘ভি’ সেইপ ইঞ্জিন।
১৯৪৯ সালে 166 inter গাড়িটি বাজারে আসে। এটি ছিল ফেরারির প্রথম ‘জি টি’(Grand Tourer) গাড়ি। যা ডিজাইন করা হয় দ্রুতগতি ও দূরপাল্লার পথে চালানোর জন্য। ফেরারি রেসিং জগতে প্রভাবশালী আলফা রোমিও এর সাথে টেক্কা দিতে নিজের টিম নিয়ে রেসে অংশগ্রহন করেন। তাঁর টিম ১৯৪৮ সালে তুরিনে প্রথম ওপেন হুইল রেসে অংশ নেয় এবং ১৯৪৯ সালে একটি ফেরারি 166 MM নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। গাড়িটি ড্রাইভ করেছিলেন লুইগি সিনেত্তি। ১৯৫০ সালে ফেরারি তখন মাত্র চালু হওয়া ফর্মুলা ওয়ান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নেন এবং এটি একমাত্র কোম্পানি যা এই চ্যাম্পিয়নশীপের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই রেসে অংশ নিচ্ছে। ফেরারির প্রথম গ্র্যান্ড প্রিক্স জয় আসে ১৯৫১ সালে, ব্রিটিশ প্রিক্স মোটর রেসিং এ জোসে ফোরলান এর হাত ধরে। শোনা যায় এই রেসে জয় নিশ্চিত হওয়ার পর এঞ্জো বাচ্চাদের মতো কেঁদেছেন!
ফেরারির প্রথম ফর্মুলা ওয়ান জয় আসে এর পরের বছরই ১৯৫২ সালে। এই রেসে আলবার্তো আসকারি T500 মডেলের গাড়িটি ড্রাইভ করেন। ১৯৫০-১৯৬৫ সালে ফেরারির সবচেয়ে বড় জয় গুলো আসে যা জনগণের কাছে এর জনপ্রিয়তা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
‘দি গ্রেট ওয়াক আউট’ এবং ফেরারির উত্থান
১৯৬০ সালে এঞ্জো তাঁর স্ত্রী লরাকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু লরাকে অযোগ্য হিসেবে মনে করায় এঞ্জো তাঁর নয়জন টপ ম্যানেজারকে বরখাস্ত করেন। যদিও তখন দক্ষ ও পেশাদার কর্মী পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতিতেও দারুনভাবে ঘুরে দাঁড়ায় এঞ্জো। সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনাকে ‘দি গ্রেট ওয়াক আউট’ বলা হয়েছে। বেশকিছু নতুন ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেন তিনি যারা ১৯৬৪ সালে 250GTO সিরিজের প্রথম গাড়িটি তৈরি করেন। এটি পরপর তিনবার ওয়ার্ল্ড স্পোরস কার চ্যাম্পিয়নশীপ বিজয়ী হয়। এরপর বাজারে আসে 275 সিরিজের গাড়িগুলো। এটি ছিল V12 পাওয়ারের ফ্রন্ট ইঞ্জিন গাড়ি। এছাড়াও ১৯৬৮ সালে দুইসিটের মিড ইঞ্জিনের ‘dino’ গাড়িটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। 275 সিরিজ এবং পরবর্তীতে ‘Daytona’ গাড়িগুলো বাজারে ফেরারির চাহিদা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালে ফেরারি কাস্টমাইজড সেবা দিতে শুরু করে। এই অনন্য বৈশিষ্ট্য ফেরারিকে গ্রাহকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। ফেরারি বাজারের বিপুল চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য ১৯৬৯ সালে গাড়ি কোম্পানি ‘ফিয়াট’এর কাছে তাঁর কোম্পানির ৫০% শেয়ার বিক্রি করে দেন। ১৯৭৩ সালে ফেরারি স্পোরস কাররেসিং থেকে অবসর নিয়ে ফর্মুলা ওয়ানে বেশি মনোযোগী হয়। ১৯৮৪ সালে কোম্পানিটি প্রথম সুপার কার তৈরি করে যার মডেল ছিল 288 GTO। এছাড়াও বেশকিছু কনসেপ্ট কার ও বাজারে আনে যার মধ্যে Mythos অন্যতম। Millechili ফেরারির সর্বশেষ কনসেপ্ট কার যা বাজারে আসে ২০১০ সালে।
১৯৮৮ সালে এঞ্জো ফেরারির মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র ছেলে পিয়েরো ফেরারি আবারো ৪০% শেয়ার ফিয়াটের কাছে বিক্রি করেন। বর্তমানে পিয়েরো ফেরারির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন। এঞ্জোর মৃত্যুর পর স্কুডেরিয়া ফেরারি টিমের বেশকিছু সাফল্য আসে। এরমধ্যে রয়েছে ওয়ার্ল্ড ড্রাইভার চ্যাম্পিয়নশীপ(২০০০-২০০৪,২০০৭) এবং কন্সট্রাক্টর চ্যাম্পিয়নশীপ (১৯৯৯-২০০৪, ২০০৭-২০০৮)। ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি ফিয়াট ফেরারির ১০০% শেয়ারের মালিকানা গ্রহন করে।
একবিংশ শতাব্দীতে ফেরারি
২০০২ সালে এঞ্জোর স্মরণে তাঁর নামে F60 গাড়িটি বাজারে আসে। একে ‘দি এঞ্জো’ নামে ডাকা হয়। এটি একটি বারো সিলিন্ডারের মিড ইঞ্জিন স্পোরস কার। প্রথমদিকে মডেলটি শুধুমাত্র বিশ্বস্ত এবং পুরনো গ্রাহকদের কেনার সুযোগ দেয়া হতো। ২০১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘ফেরারি ড্রাইভিং ইভেন্ট’ উদযাপন করার জন্য ইংল্যান্ডের সিলভার স্টোন সার্কিট এ একটি প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ৯৬৪টি ফেরারি গাড়ি অংশ নেয় যা একটি রেকর্ড।
২০১৪ সালে ব্র্যান্ড ফিন্যান্স ফেরারিকে ‘মোস্ট পাওয়ারফুল ব্র্যান্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ২০১৮ সালে ফেরারির ১৯৬৪ সালে তৈরি 250 GTO গাড়িটি সত্তর মিলিয়ন ডলার এ বিক্রি হয় যা ইতিহাসের সবচেয়ে দামি গাড়ির মর্যাদা পেয়েছে। ২০১৮ সালের শেষে ফেরারির বিক্রিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ২০৮,৯৩১ টি। সারাবিশ্বে বর্তমানে গাড়ির শোরুম রয়েছে ত্রিশটি যার মধ্যে দুইটি ফেরারির নিজস্ব এবং বাকিগুলো বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজি পরিচালনা করে।
ফেরারির ইতিহাস আসলে একজন কামারের শিল্পপতি হয়ে ওঠার গল্প। এঞ্জো ফেরারির এই সংগ্রামী এবং নিষ্ঠাবান জীবনযাত্রা ও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের যে মনোভাব, তা যেকোনো মানুষকে উৎসাহ দিবে তার স্বপ্নের পিছনে নিষ্ঠার সাথে চলার জন্য।