কুসংস্কার হচ্ছে মানুষের মনগড়া কিছু ভ্রান্ত ধারণা যেগুলো মানুষ যুগ যুগ ধরে অবচেতন মনেই করে আসছে। শহরে বা গ্রামে সব জায়গায়ই এই কুসংস্কার বিদ্যমান। কেউ ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মানেন কেউবা মানেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে বড় বড় সেলিব্রেটিরাও বিশ্বাস করেন এসব কুসংস্কার আর কুপ্রথায়। কেউ মানেন কোন নির্দিষ্ট নম্বর কেউবা মানেন নির্দিষ্ট কোন রঙ আবার কেউ ব্র্যান্ডের কাপড় বা জুতা পড়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করেন । কিছু কার রেসার রেসের দিন সকালে দাঁড়ি কামান না। আবার যদি কখনো কোন দুর্ঘটনা ঘটে তখন সেই দুর্ঘটনার আশেপাশের সবকিছুই হয়ে যায় আনলাকি। নেসকার কার ড্রাইভারদের মধ্যেও রয়েছে কিছু কুসংস্কার। তারা বিশ্বাস করে যে কিছু জিনিস উত্তেজনাপূর্ণ রেসের আগে তাদের নার্ভকে শান্ত রাখে আর তাদেরকে অলৌকিকভাবে রেসে জয়ী করতে সাহায্য করে। একবার কোন কিছু করে সফলতার দেখা পায়, তাহলে পরের বারও সফলতার আশায় সেই একই কাজ করেন ।
যদিও কার রেসের সাথে কুসংস্কারের কোন সম্পর্কে থাকেনা তবু ফর্মুলা কার রেস করেন যারা তারা কোন ঝুঁকি নিতে চান না। গাড়ির নাম্বার প্লেটকেও অনেকে লাকি অথবা আনলাকি মনে করেন। নেসকার আর মোটো জিপি ড্রাইভারদের নাম্বার প্লেট পালটানো হয়না কিন্তু প্রায় প্রত্যেক বছর ফর্মুলা কার রেসারদের গাড়ির নম্বর প্লেট তাদের র্যাঙ্ক অনুযায়ী পালটানো হয় । ২০১৪ সালে যখন F-1 ড্রাইভারদের তাদের পছন্দনুযায়ী স্থায়ী নাম্বার নিতে বলা হল তখন তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা তাদের ভাগ্যের সাথে মিলিয়ে গাড়ির নাম্বার প্লেট পছন্দ করায় লেগে পড়ে। আর এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে যে, রেসিং জগতে গাড়ির নাম্বার প্লেট নিয়ে এখনো অনেক কুসংস্কার রয়েছে।
কাপড়চোপড়
অন্য কোন কিছু চিন্তা না করেই কিছু রেসার একই রকম কাপড় বারবার পড়ে রেসে অংশগ্রহণ করে । তারা মনে করেন তাদের রেসে জয়ী হওয়া বা হেরে যাওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কাপড়চোপড়ও ভূমিকা পালন করে। শুনতে হাস্যকর হলেও এটা সত্যি যে তারা এগুলোও মনেপ্রানে বিশ্বাস করে। ড্রাইভার ব্রায়ান স্কট বলেন , তিনি কিছু ড্রাইভারের কাছে শুনেছেন মানুষের শরীরের ডানপাশ থাকে সৌভাগ্য বয়ে আনে। যেকোনো কাপড় বা অন্য যেকনো কিছু পরার সময় প্রথমে ডানদিক এবং খুলে ফেলার সময় বামদিক থেকে খুলতে হয়। মোটোজিপি ড্রাইভার ভ্যালেন্টিনো রোসি তার প্রত্যেক রেসের আগে এই কাপড়চোপড় সংক্রান্ত কুসংস্কার অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন।
দুই পায়ে দুই রকম জুতা
দুই পায়ে দুই রকম জুতা পড়ে সবথেকে বেশী সমালোচনায় এসেছিলেন অস্ট্রিয়ান কার রেসার অ্যালেক্স ওয়ার্জ । আরেকটি কুসংস্কার হচ্ছে, রেসাররা প্রায়ই দু পায়ে দুই রকম মুজা পরে থাকে। স্টেফানো মেডোনার কুসংস্কার ছিলো আরো অদ্ভুত! তিনি গাড়ি চালানোর সময় একটা গ্লভস পড়তেন আরেকটি গাড়ির ভিতরে খুলে রাখতেন। যেটা করাতে তার গাড়ি চালাতেও অসুবিধা হত। তবুও তিনি তার এই নিজস্ব রীতি মেনে চলতেন।
লাকি চার্ম
অনেক রেসার নিজের গাড়ির সামনের আয়নার সাথে কিছু একটা ঝুলিয়ে রাখে। ঝুলিয়ে মনে করে সেই জিনিসটি তাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাবে বা রেসে বিজয়ী হতে সাহায্য করবে। কেউ ড্যাশ বোর্ডে ধর্মীয় ছবি বা চিহ্ন এঁকে রাখে বা প্রিয় মানুষের ছবিও রাখেন। কোন লাকি কয়েন বা খরগোশের পায়ের মত দেখতে কোন চাবির রিং সবই হচ্ছে কুসংস্কারের অংশ। রেস কার ড্রাইভাররা যেহেতু অনেকটা সময় ধরে গাড়িতে থাকে তাই তারা এসব জিনিস দিয়ে নিজের মনকে বিপদ থেকে নিশ্চিন্তে থাকার সান্তনা নেন।
ইটালিয়ান রেস এবং নেসকার ড্রাইভার টেযিও নুভোলারি একটি কচ্ছপ সম্বলিত পিন ব্যবহার করতেন। তিনি মনে করতেন এটি তার লাকি চার্ম। তিনি এটি পরতেন তাবিজ হিসেবে! বিখ্যাত রেসার সাবস্টেন ভেটেল একটি কয়েন তার সাথে রাখেন যেটাকে তিনি তার ‘লাকি কয়েন’ বলে মনে করেন। এরকম আর অনেকেই আছেন যারা নিজেদের সৌভাগ্যের জন্য অনেক কিছুই বহন করতেন যা তারা লুকিয়ে রাখতেই বেশী পছন্দ করতেন।
গাড়ির সাথে কথোপকথন
কিছু ড্রাইভার গাড়িকে তাড়াতাড়ি চলার জন্য তাড়া দিয়ে থাকেন। রেসিং ট্র্যাকে থাকার সময় এই কাজটি করেন অনেকেই। হাস্যকর হলেও একজন ড্রাইভারের জন্য এটাই স্বাভাবিক । রেসার ভ্যালেন্টিনো রোসি বলেন যে, তিনি রেসের শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে তার মোটরসাইকেলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মোটরসাইকেলের সাথে কথা বলতেন। তিনি আরো বলেন, এই কথা বলাটা হচ্ছে তার নিজের জন্য , তিনি নিজের মনের শান্তির জন্য এমনটা করেন।
বাম পাশ দিয়ে গাড়িতে ওঠা
একই জিনিস বারবার করে যাওয়াটা আপাত দৃষ্টিতে অদ্ভুত হলেও অধিকাংশ কার রেস ড্রাইভাররা এমন অনেক কিছুই করে থাকে। সাধারণত তারা বাম দিক থেকেই গাড়িতে ওঠেন। দুজন F-1 ড্রাইভার নিকো হোগেনবার্গ এবং মার্ক ওয়েবার মনে করতেন, বামদিক থেকে গাড়িতে উঠলে তা সৌভাগ্যজনক। যোওয়ান পাবলো সবসময় একই পাশ থেকে, একই ভাবে সীটবেল্ট বাঁধেন, গাড়িতে চড়েন ও রেস করেন। একইভাবে মোটরসাইকেল চালানোর সময়ও ড্রাইভারদের এই নিয়ম মানতে দেখা যায়।
আনলাকি থার্টিন
১৩ নম্বরটি সব সময় আনলাকি হিসেবে ধরা হয়। নেসকার রেসে গাড়িগুলোর নম্বর কখনই ১৩ রাখা হয় না। জো ওয়েথরলো একবার একটি রেসে ১৩ তম হয়েছিলেন কিন্তু তাকে ১২ নম্বর ধরা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে যখন সব ফর্মুলা ড্রাইভারদের তাদের পছন্দের নম্বর নির্বাচন করতে বলা হয়েছিল তখন প্যাসটর মোলডনাডো ১৩ নম্বরটি বেঁছে নিয়েছিলেন।
নির্দিষ্ট কোন খাবার খাওয়া
ড্যানিকা প্যাট্রিক বলেন, তিনি কোন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নন। কিন্তু এমন কিছু খাবার আছে যা তিনি রেসের দিন সকালে খান যেগুলো তার এনার্জি ধরে রাখতে সাহায্য করে। স্টারলিং মারলিন একবার একটি স্যাণ্ডউইচ খেয়ে জয়ী হন তারপর থেকে প্রত্যেক রেসের আগে তিনি স্যাণ্ডউইচ খেতেন। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ান নেসকার ড্রাইভার মার্কোস এমব্রোসও রেসের আগে নির্দিষ্ট কিছু খাবার খেতেন।
চিনাবাদামের খোসা
যেখানে নেসকার প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে সেখানে ড্রাইভাররা কখনোই খোসা যুক্ত চিনাবাদাম নিয়ে আসার অনুমতি দেন না। তারা মনে করেন খোসা যুক্ত চীনা বাদাম দুর্ভাগ্য বয়ে আনে । দুটি দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথম দুর্ঘটনা যখন ঘটে ল্যংঘর্নে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি কিছু দর্শককে আহত করে ফেলে, কিছু মানুষ মারাও যায়। আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে ন্যাশভিলে ফেয়ার গ্রাউন্ডসে রেস চলাকালীন সময়ে। তখন ৪/৫ টি গাড়ির সংঘর্ষ হয় এবং একজন ড্রাইভার মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান দুটো দুর্ঘটনার জায়গাতেই চীনা বাদামের খোসা পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। আরো অনেক গুলো গাড়ির রেসের দুর্ঘটনার সময় চীনা বাদামের খোসা পড়ে থাকতে দেখা যায় যার ফলে এরপর থেকে পুরো রেসিং গ্রাউন্ড থেকে চীনা বাদাম নিষিদ্ধ করা হয়।
সবুজ রঙয়ের গাড়ি
১৯২০ সালে লুইস শেভ্রোলেট যখন সবুজ রঙয়ের গাড়িতে রেস করার সময় মারা যান তখন থেকে এই সবুজ রঙের গাড়ির কুসংস্কারটি শুরু হয় । তখন থেকে সবুজ রঙের গাড়িগুলো ড্রাইভারদের পছদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় । তখন থেকে সব সময় তারা এই আনলাকি রঙয়ের গাড়ি ব্যবহারে অসম্মতি জানান।
ব্যাপারটা যে শুধু দুর্ভাগ্য এড়ানো তা নয়, সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসাও বটে। খ্যাতি আর গৌরবময় জায়গায় নিজেকে দেখার জন্য রেসিং কার ড্রাইভাররা এই জীবন বেঁছে নেয় । আর কিছু রেসার শুধুই ভক্তদের মন জয় করার জন্য কার রেস করে থাকেন। আর কেউ কেউ শুধুই শখের বশে কিছু উত্তেজনাপূর্ণ সময় কাটাতে পছন্দ করেন। কেউ কেউ তাদের ভয়-ভীতি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন আবার কেউ পুরো ব্যাপারটা চেপে যান যাতে তার দুর্বলতার ব্যাপারে প্রতিপক্ষ জেনে না ফেলে।