প্রহরী

পড়তে লাগবে: 5 মিনিট

যুগে যুগে রোলস রয়েস: যে কোম্পানি শুধু বিলাসবহুল গাড়ি বানায়!

রোলস রয়েস নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই । রোলস রয়েস খুব অল্প সংখ্যক গাড়ি তৈরি করে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকটি গাড়ি হয় দামী, জাঁকজমকপূর্ণ ও দেখার মত । বিশ্বের সবথেকে দামী এবং বিলাসবহুল গাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে রোলস রয়েস অটোমোবাইল কোম্পানি সবার প্রথমে। বেশী দাম হওয়া স্বত্বেও এর চাহিদা আকাশচুম্বী। রোলস রয়েসের ইতিহাস নিয়ে কিছু দারুণ তথ্য নিয়ে আজকের এই লেখাটি।

রোলস রয়েসে ব্যবহৃত প্রতীকটি হচ্ছে ডাবল আর (RR) – যা পরম আনন্দের সমার্থক আর তিন-তারা খচিত প্রতীকটি হচ্ছে বিলাসবহুল গাড়ির প্রতীক। চার্লস রোলস আর ফ্রেডরিখ হেনরি রয়েসের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজকের ‘রোলস রয়েস’ । তারা এই দুর্দান্ত একটি গাড়ি তৈরি করেছিলেন, আর তাদের নামের সাথে মিলিয়ে নামকরন করেছিলেন ‘রোলস রয়েস’। তারা গাড়ির সাথে সাথে জেট ইঞ্জিনও তৈরি করেছিলেন । রোলস রয়েস প্রতিষ্ঠানটি  প্রতিরক্ষা আর বেসামরিক বাহিনীর জন্য বিমান তৈরি করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল।

রোলস রয়েসের দুটি “R” দ্বারা বোঝানো হয় এই প্রতীকটি ।

স্যার ফ্রেডরিখ হেনরি রয়েস ছিলেন একজন খেটে-খাওয়া দিনমজুরের সন্তান। তিনি নয় বছর বয়স থেকে পেপার বিক্রি করে স্কুল এবং রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে তার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন। অপরদিকে,চার্লস রোলস ছিলেন যুক্তরাজ্যের এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তিনি তার পড়ালেখা শেষ করেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানে তিনি মেকানিক্যাল সাইন্সের উপর স্নাতক অর্জন করেছিলেন। তার গাড়ির ব্যবসা ছিল আর পাশাপাশি তিনি ছিলেন রেসিং কার ড্রাইভার।

হেনরি এডমান্ডস ছিলেন রয়েস লিমিটেডের একজন পরিচালক আর তার মাধ্যমেই রোলস এবং রয়েসের পরিচয় ঘটে। এডমান্ডস রয়েসের তৈরি গাড়ীগুলো রোলসকে দেখানোর ব্যবস্থা করেন এবং তাদের সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাতের ব্যবস্থাও তিনিই করে দেন।

তাদের তৈরি প্রথম রোলস রয়েস গাড়িটি ছিল ১০ হর্স পাওয়ার (অশ্ব শক্তি)। রুপালি রঙয়ের, ৭.০-লিটারের ছয় ইঞ্জিন বিশিষ্ট, চারজন যাত্রী বসার মত ছিল এই প্রথম রোলস রয়েস কারটি। সেই সময়ে গাড়িটি ছিল বিশ্বের সেরা ।

প্রথম তৈরি রোলস রয়েসের নাম ছিল ‘সিল্ভার ঘোস্ট’ ।

১৯১০ সালে একটি প্রদর্শনীর সময় প্লেনের পাখা ভেঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় চার্লস রোলসের আকস্মিক মৃত্যু হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। চার্লস রোলসের মৃত্যুর পর হেনরি রয়েস কোম্পানিটি চালিয়ে নেন।

১৯২১ সাল ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিপুল চাহিদার কারনে যুক্তরাষ্ট্রে রোলস রয়েসের প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের যুগকে বলা হয় ‘জ্যাজ এরা’। সেই যুগেও রোলস রয়েস গাড়ীগুলো ছিল সবথেকে দামী আর রাজকীয় গাড়ি। তখন আমেরিকান ধনাঢ্য ব্যাক্তি ও পরিবারগুলোর মধ্যে গাড়িটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

 বেন্টলীর সাথে রোলস রয়েস

১৯৩০ সালে অর্থনৈতিক বাজারে প্রচণ্ড মন্দা চলাকালীন সময়ে, এই মার্কিন গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বেন্টলী’র কিছু শেয়ার কিনে নেয়। তারা একই রকমের সকল যন্ত্রাংশ গুলো নিজেদের মধ্যে আদান প্রদান করে কাজ করতো। যা পরবর্তী ৭০ বছরের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক অংশীদারি হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ১৯৩৩ সালে, ৭০ বছর বয়সে হেনরি রয়েস মৃত্যুবরণ করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, তিনি তার প্রতিষ্ঠানের সেই সফলতাগুলো দেখে যাতে পারলেন না।

রোলস রয়েস ও বেন্টলি আলাদা হয়ে যায় ২০০২ সালে।

‘জ্যাজ এরা’ যুগের রোলস রয়েস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রোলস রয়েস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রোলস রয়েস ক্রু আর চেশায়ারে গাড়ি তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিল।  যেখানে রুপালি পেইন্টিং কাজটুকু ছাড়া পুরো গাড়ির বডি কিছু বিশেষজ্ঞ দ্বারা নির্মাণ করা হত । ১৯৪৬ সালে ক্রু’র এই কারখানাটি কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে পরিণত হয়। এরপর ডেট্রয়েট ও মিশিগানে প্যাকার্ড মোটর কার কোম্পানির সাথে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য বিমান তৈরি করেছিল।

পঞ্চাশ দশক ও রাজকীয় পরিবার

১৯৫০ দশক ছিল রোলস রয়েসের অগ্রযাত্রার প্রাথমিক দিক। তারা রাজকীয় পরিবাবের সাথে ফ্যান্টম-IV গাড়ি তৈরির চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। রাজ পরিবারের জন্য তারা মোট ১৮ টি ফ্যান্টম IV তৈরি করে যার প্রত্যেকটা গাড়ি ছিল অসাধারন। ১৯৮৫ সালে ডায়ানা একটি রোলস রয়েস ব্যবহার করেছিলেন যার নাম ছিল “সেঞ্চিনারি”  ।

ষাট  দশকে রোলস রয়েস

৬০ দশকে এই রোলস রয়েসের ক্রেতা শ্রেনীতে বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। বিখ্যাত সঙ্গিত শিল্পী,তারকা সহ গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন মিডিয়ার সেলিব্রেটিরা এই রোলস রয়েস কেনায় আগ্রহী হন। ১৯৬৫ সালে নতুন করে আবারো হালকা রুপালি রঙের ব্যবহার হয়। প্রায় ২,১০০ কেজি ওজনের ৬.২ ও ৬.৭৫ লিটার ইঞ্জিনের সাহায্যে চালিত হত তখনকার রোলস রয়েস গাড়ীগুলো ।

প্রিন্সেস ডায়নার ব্যবহৃত রোলস রয়েস গাড়ি।
সত্তর দশকে বিভক্তি

১৯৭০ সালে বিমান ইঞ্জিন বিষয়ক ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশ সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু তাদের কোন সাহায্য করেনি সরকার। তখন রোলস রয়েসের ক্রুতে অবস্থিত কারখানার মোটর দল, রোলস রয়েস লিমিটেড থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আলাদা হয়ে তারা বেশ কিছু মডেলের গাড়ি বাজারজাত করেছিল।  গাড়ীগুলোর মধ্যে ছিল কর্ণিশ, ক্যামার্গ, সিল্ভার শ্যাডো II, সিল্ভার রেইথ II,  যেগুলো ১৯৬৯ সালে বাজারে এসেছিল।

আশির শতক ও ভিকার্স পিএলসি

১৯৮০ সালে ভিকার্স পিএলসি রোলস রয়েসকে কিনে নেয়। পরে রোলস-রয়েসের ব্যবহৃত রুপালি আভাটির ভিতরে কিছু নতুনত্ব এনে উন্নত করা হয়। দু’টি গাড়িই ছিল বিশালাকৃতির। সেই যুগেও বহু মূল্যবান ছিল গাড়িগুলো।

১৯৯০ সালে ভিকার্সের চুক্তি শেষ হয়ে গেল। তখন আবার রোলস রয়েস আবার বিক্রির জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে ক্রু-তে রোলস রয়েসের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এর ফলে রোলস রয়েসের বিংশ শতাব্দীর আধুনিক যুগ সূচনা হয়। বিএমডাব্লিউ রোলস রয়েসের সত্ত্বা কিনতে আগ্রহী হয়। কিন্তু ভক্সওয়াগন ৪৩০ মিলিয়ন পাউন্ডে তাদের গাড়ি প্রস্তুুতকারকদের কিনে নেয়।

ভক্সওয়াগন শুধু নকশার অধিকার ধরে রেখেছিল, যেখানে বিএমডব্লিউ রোলস রয়েসের দুটি “R” সম্বলিত প্রতীকটির সত্ত্বা ধরে রেখেছিল। যেহেতু ভক্সওয়াগন চেয়েছিল বেন্টলি যেন “RR” প্রতীকটি বিএমডব্লিউয়ের কাছে ৪০ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি করে। পরে ভক্সওয়াগন বেন্টলির গাড়ি বানাবে আর বিএমডব্লিউ রোলস রয়েসের গাড়ি উৎপাদন করবে, এমন একটি সমঝোতার ভিত্তিতে এই বড় গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আবার আলাদা হয়ে যায়।

একুশ শতকে রোলস রয়েস

রোলস রয়েস তার একুশ শতকে পা দেওয়ার পরের নয় বছরে তারা ফ্যান্টমের বেশ কিছু সংস্করণ তৈরি করেছে। সেগুলো ছিল ফ্যান্টম এক্সটেন্ডেট হুইলবাস, ড্রপহেড কুপ, ফ্যান্টম II, ফ্যান্টম কুপ ।

একুশ শতকের চকচকে রোলস রয়েস।
রোলস রয়েস সম্পর্কে আরো কয়েকটি তথ্যঃ
  • রোলস রয়েসের প্রথম গাড়িটির নাম ছিল ‘সিল্ভার ঘোস্ট” ,গাড়িটি একনাগারে প্রায় ২৪,০০০ কিমি চলে একটি রেকর্ডের সৃষ্টি করেছিল।
  • এই পর্যন্ত প্রায় ৬৫ শতাংশ রোলস রয়েস গাড়ি তৈরি করা হয় যা এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে।
  • ২০০৩ সালে বিএমডাব্লিউ রোলস রয়েসের আরেকটি সংস্করণ আনে তার নাম দেয় ফ্যান্টম,যার প্রায় ৪৪ টি রঙ আছে।
  • প্রত্যেকটি ফ্যান্টম কারগুলো জার্মানিতে তৈরি করা হয়, একটি ফ্যান্টম গাড়িতে ২০০ ভাগ অ্যালুমিনিয়ামের আর প্রায় ৩০০ টি খাদ হাতে ঝালাই করে বসানো হয়। এক একটি ফ্যান্টম কার তৈরি করতে প্রায় দুই মাস সময় লেগে যায়।
  • ফ্যান্টম কারের ইঞ্জিন ৫.৯ সেকেন্ডে  শুন্য থেকে ১০০ কিমি/ঘন্টা উঠতে পারে।
  • ফ্যান্টম কারের ছাদে ব্যবহৃত গয়নার মত নকশা গুলো গভীর আনন্দের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
  • প্রত্যেকটি ফ্যান্টম কারের ছাদ টেফলন কাপড়ের ছাতার মত হয় আর একটি বাটন থাকে যার মাধ্যমে ছাদটি খোলা যায়।
  • প্রত্যেকটি ফ্যান্টম কারের ভেতরের সাজসজ্জার জন্য ৭৫ স্কয়ার মিটার জায়গার প্রয়োজন হয়। শুধু একটি গাড়ির সাজসজ্জার জন্য প্রায় ১৭ দিন সময় লাগে।
  • রোলস রয়েসের একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল, যখন গাড়িটি কারখানা থেকে বের হয়ে আসে তখন এর কোচ লাইনটি হাতে পেইন্ট করা হয়, কোন মেশিন না, কোন রোবট না, এই পেইন্ট করার অনুমতি প্রাপ্ত মানুষটি হচ্ছেন ‘মার্ক কুটস । মার্কের এই কাজটি খুবই মনোযোগের সাহায্যে করতে হয় কারন এখানে ভুল হলে কোন মোছা বা পালটানোর কোন সুযোগ থাকেনা।

রোলস রয়েসের খ্যাতি পৃথিবী জোড়া। বিশ্বের সবচেয়ে দামী ও আকর্ষণীয় খেতাবের সাথে সাথে রোলস রয়েস তার মানও বজায় রেখেছে.। এখনো পর্যন্ত সবথেকে বিলাসবহুল গাড়ি হিসেবে পরিচিত এই রোলস রয়েস।

    গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী সম্পর্কে জানতে

    Share your vote!


    এই লেখা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
    • Fascinated
    • Happy
    • Sad
    • Angry
    • Bored
    • Afraid

    মন্তব্যসমূহ

    Scroll to Top