রায়হান সাহেব সকাল সকাল একটু তাড়াহুড়ো করেই নিজের গাড়ি নিয়ে অফিসের দিকে রওনা হলেন। কিছুদূর যাওয়ার পরেই পথ রোধ করে দাঁড়ালো ট্রাফিক পুলিশ। গাড়ির জানালা খুলে ট্রাফিক পুলিশের দিকে তাকাতেই; কর্তব্যরত পুলিশ তার ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চাইলো। কিন্তু বিধি বাম! সব কাগজপত্র দেখাতে না পারায় পুলিশ গাড়ি আটক করল।
গতকাল গাড়ির সার্ভিসিং করানোর সময় এসব দরকারি কাগজপত্র গাড়ি থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। আর আজ সকালের তাড়াহুড়োয় সেগুলো নিয়ে বের হতেও ভুলে গিয়েছেন! এদিকে রাজধানীতে চলছে ট্রাফিক সপ্তাহ। রাস্তায় মেয়াদউত্তীর্ণ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি তো আটক হচ্ছেই। পাশাপাশি গাড়ি চলকরা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালালচ্ছেন কিনা, বা রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ আছে কিনা তাও চেকিং করছেন ট্রাফিক পুলিশ। যার গাড়িতে বা কাগজপত্রের ঝামেলা হচ্ছে তার গাড়ি আটক হচ্ছে বা কাগজপত্র রেখে দিয়ে মালমা দেয়া হচ্ছে। ট্রাফিক আইন অমান্য করলেও মামলা ভোগ করতে হচ্ছে চালকদের। রায়হান সাহেব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। ফলে তার গাড়িও আটকে দেয়া হয়েছে এবং মামলা প্রদান করা হয়েছে।
রায়হান সাহেবের মতো অনেকেই ইদানীং এই রকম ঝামেলায় পড়ছেন। একজন ট্রাফিক পুলিশ চাইলে আইনের আওতায় থেকে আপনার কোন অনিয়মের জন্য আপনার গাড়ি আটক করতে পারে। এটা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু গাড়ি আটক হলে বা পুলিশ যদি মামলা দিয়ে দেয় তাহলে কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে তা অনেকেই জানেন না।
কী কী কারণে আপনার গাড়ি আটক হতে পারে বা পুলিশ আপনাকে মামলা দিতে পারে তা ট্রাফিক আইন পড়ে নিলেই জানতে পারবেন।
মোটরযান আইনে গাড়ি চালানো সংক্রান্ত অপরাধ এবং শাস্তি
মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে
অনেকেই আছেন যারা ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালে বিরক্ত বোধ করেন বা মাথা গরম করে ফেলেন। এটা করা অনুচিত। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গাড়ি এবং ড্রাইভারের কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা তা প্রয়োজনবোধে চেকিং করার ক্ষমতা রাখেন। অনেকে গাড়ি আটক করলে বা পুলিশ চেকিং এর জন্য থামালে ঘাবড়ে যান। ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। পুলিশ যেসব কাগজপত্র দেখতে চায় সেসব কাগজপত্র দেখান। তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করুন এবং সহযোগিতা করুন।
মামলার রসিদ বুঝে নিন
আপনার গাড়ির কাগজপত্র কোন সমস্যা থাকলে বা ট্রাফিক আইন অমান্য করলে পুলিশ আপনার গাড়ির কাগজপত্র জব্দ করে রেখে দিবেন। এবং আপনাকে একটি মামলার রসিদ দেয়া হবে। মামলার রসিদের সবকিছু ভালোভাবে বুঝে নিন। কোন কারণে মামলা দেয়া হলো। কত টাকার মামলা দেয়া হলো। কে মামলা দিলো, কোথায় জরিমানা প্রদান করতে হবে। এই সবকিছুই জরিমানা বা মামলার রসিদে উল্লেখ করা আছে কিনা দেখে নিন।
সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ অফিসে যোগাযোগ
মামলা প্রদানের সময় জরিমানার যে রশিদ দেয়া হয়, সেই রশিদের মধ্যে লিখা থাকে কবে কোথায় গিয়ে জরিমানা প্রদান করে জব্দ করা কাগজ ছাড়িয়ে আনতে হয়। রশিদে উল্লেখিত তারিখ সময় এবং অফিসের ঠিকানা দেখে যথা সময়ে সেই অফিসে উপস্থিত হতে হবে।
জরিমানা প্রদান ও কাগজপত্র ফেরত নেয়া
সংশ্লিষ্ট জোনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার জরিমানার বিনিময়ে মামলার নিষ্পত্তি করতে পারেন। আবার তিনি চাইলে জরিমানা মউকুফও করে দিতে পারেন। জরিমানা প্রদানের জন্য রশিদের উল্লেখিত সংশ্লিষ্ট জোনাল অফিসে গিয়ে জরিমানা প্রদান করে, আপনি পুলিশ কর্তৃক জব্দকৃত আপনার কাগজপত্র ফেরত নিয়ে আসতে পারবেন।
তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় যদি মামলা দেয়া হয় তাহলে অনলাইন বা ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে আপনার জরিমানা প্রদান করতে পারবেন। এই উপায়ে জরিমানা প্রদান করলে জব্দ হওয়া কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট জোনাল অফিস থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে আপনার বাসায় পৌঁছে দেয়া হবে। তবে ঢাকার বাইরে এই সুবিধা এখনো সর্বত্র ভাবে চালু হয়নি।
যদি সঠিক সময়ে জরিমানা না দিতে পারি?
যদি রশিদে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জোনাল অফিসে উপস্থিত থাকতে না পারেন বা জরিমানা দিতে না পারেন, তাহলে মামলার বিস্তারিত সহ প্রতিবেদন আকারে মামলাটি আদালতে প্রেরণ করা হতে পারে। মামলার বিপরীতে আদালত ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে পারে। আদালতের একটি শাখা রয়েছে, যে শাখায় মোটরযান সংক্রান্ত মামলার কাজ নিষ্পন্ন করে থাকে। আপনি যদি যথা সময়ে জরিমানা দিতে না পারেন এবং আপনার মামলাটি আদালতে প্রেরণ করা হয়। তাহলে আপনাকে আদালতে উপস্থিত হয়ে জারিমানা প্রদান করে মামলা থেকে অব্যাহতি নিতে হবে।
পুলিশ যদি কোন কারণে গাড়ি নিয়ে যায়?
আইন ভঙ্গের মাত্রা বা অপরাধের মাত্রা যাচাই করে ট্রাফিক পুলিশ আপনার গাড়িটি আটক করে রেখে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে গাড়িটি আবারো নিজের জিম্মায় নেয়ার জন্য কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। প্রথমে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে মামলার এজাহারের কপি তুলে নিতে হবে। এর সাথে গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের ফটোকপি নিয়ে একজন আইনজীবীর সাথে কথা বলতে হবে। আইনজীবী বিচারক ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে গিয়ে মামলার নথি পর্যবেক্ষণ করবেন। প্রথম দিনের শুনানি শেষ হলে, আদালত মামলার ইনভেস্টিগেটর এবং বিআরটিএকে গাড়ির মালিকানা নিরূপণের জন্য আদেশ প্রদান করবেন। পাশাপাশি কোন অপরাধের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তাও যাচাই করে দেখতে বলবেন।
যেহেতু গাড়ি থানায় আটক করা হয়ে থাকে। তাই আদালত থানায় আদেশ পাঠিয়ে দেয়, তারপর থানায় গিয়ে যোগাযোগ করতে হবে, যেন তদন্তকারী কর্মকর্তা দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে প্রেরণ করে দেন। থানা থেকে প্রতিবেদন আবার আদালতে প্রেরণ করা হলে আইনজীবী তা পর্যবেক্ষণ করে দেখবেন। এরপর আইনজীবী একটি সাক্ষরের মাধ্যমে গাড়ির মালিকানা নিরূপণের ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করবেন। এই শুনানির দিন গাড়ির মালিককে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে। আদালত যদি বিআরটিএ, তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিবেদন এবং আইনজীবীর শুনানিতে সন্তুষ্ট হয় তাহলে আবার থানা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করবেন এবং গাড়িটি মালিকের জিম্মায় দেয়ার নির্দেশ দিবেন। এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে আবার যোগাযোগ করে গাড়িটি নিজের জিম্মায় নিতে হবে। তবে শর্ত থাকবে যে, তদন্তকারী কর্মকর্তা পরবর্তীতে তদন্তের জন্য গাড়িটি আবার থানায় হাজির করতে পারবেন। এভাবে আটক করা গাড়ি নিজের জিম্মায় নিতে ১ মাসের মতো সময় লাগতে পারে।
সবসময় ট্রাফিক আইন মেনে চলুন। গাড়িতে সব সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখুন। তাহলে অনেক ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এবং দুর্ঘটনা এবং দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে পারেন। আর গাড়িকে আপনার নজরদারিতে রাখতে ভেইকেল ট্র্যাকার ব্যবহার করতে পারেন। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি প্রহরী ভেইকেল ট্র্যাকার এখন আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে।