প্রহরী

পড়তে লাগবে: 5 মিনিট

বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় অটোরিকশা ‘টুকটুক’

বাংলাদেশে সাধারণত রিকশা আর অটোরিকশার কিছু পার্থক্য রয়েছে। রিকশা বলতে পায়ের প্যাডেল চালিত তিন চাকার বাহন বুঝায়। আবার অটোরিকশা বলতে আমাদের দেশে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন বোঝায়। এখন কিছু রিকশাও বের হয়েছে যেগুলো প্যাডেলের বদলে ব্যাটারিতে চলে। কাছাকাছি এবং কম খরচে যাওয়া আসা করার মাধ্যম হিসেবে রিকশা বা অটোরিকশার কোন বিকল্প নেই। বর্তমানে অটোরিকশার মধ্যেও আবার কিছু পার্থক্য দেখা যায়,অটোরিকশার মধ্যে রয়েছে ইজিবাইক,ইঞ্জিন চালিত অটোরিকশা আর সিএনজি। বাংলাদেশের বিভিন্ন মফঃস্বল শহরে এখন এই ইজিবাইক বা অটোরিকশাগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শুধু বাংলাদেশ বা এশিয়ান অঞ্চলে নয়, বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অটোরিকশা টুকটুক । একেক দেশের অটোরিকশা আবার একেক রকম। তবে বেশিরভাগ দেশেই অটোরিকশা টুকটুক নামেই বেশি পরিচিত।

সর্বপ্রথম জাপান এই তিন চাকার যানটি থাইল্যান্ডে রপ্তানি করে ১৯৩৪ সালে। জাপানের ‘মিনিষ্ট্রি অফ পোস্ট’ প্রায় ২০,০০০ অটোরিকশা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সরবরাহ করে। অনেক ধরনের ,অনেক ডিজাইনের, অনেক প্রকারের অটোরিকশা এখন তৈরি হচ্ছে। তবে সবথেকে বেশী ব্যবহৃত হয় যে মডেলটি, তার বডি শীট ও ধাতুর তৈরি। আর ছাদ হচ্ছে রংতুলিতে আঁকা পর্দা দিয়ে বানানো। কিছু রিকশায় চালকের আলাদা জায়গা বাসার থাকে সেগুলোকেই অটোরিকশা বলে।

থাইল্যান্ড: টুকটুকের শুরু যেখানে

থাইল্যান্ড হচ্ছে পর্যটকদের একটি অন্যতম পছন্দের জায়গা। প্রত্যেক বছর হাজারো মানুষ থাইল্যান্ডে ভ্রমণের জন্য আসে। থাইল্যান্ডেই মুলত এই রিকশাকে বলা হয় ‘টুকটুক’। থাইল্যান্ডের এই টুকটুক অটোরিকশা গুলো চলার সময় অনেক শব্দ হয়। দেখতে রংবেরঙর বাহারি এবং তিন চাকা বিশিষ্ট। টুকটুক অটোরিকশাগুলো সাধারণত সরু রাস্তায় চলাচলের জন্য খুবই উপযোগী।

থাইল্যান্ডে জনপ্রিয় অটোরিকশা ‘টুকটুক’।

থাইল্যান্ডের  টুকটুক অটোরিকশা চলে অটো ইঞ্জিনের মাধ্যমে। এখন বাংলাদেশেও অনেক অটোরিকশা আছে যেগুলো এমন ব্যাটারি চালিত ইঞ্জিন দিয়ে তৈরি। থাইল্যান্ডে টুকটুক অটোরিকশা বেশী জনপ্রিয় কারন, এগুলো দামে সস্তা এবং ওখানকার উষ্ণ আবহাওয়ায় এই রিকশায় চড়তে খুবই আরামদায়ক।

এশিয়া

বাংলাদেশ: রিকশা  মূলত মানুষের গায়ের শক্তি দিয়ে চালানো হয় যা সত্যিকার অর্থে খুবই অমানবিক ,কলকাতায় এধরনের রিকশাকে টাঙ্গা বলা হয় । আর বাংলাদেশে যে রিকশা চলে তা প্যাডেল দিয়ে, সাইকেলের মত। প্রথমে ছিল বেবি ট্যাক্সি আর এখন সিএনজি আর ইজিবাইক নামে চলে এসব যান। পরিবেশ দূষণ রোধে ২০০৬ সালে ঢাকা থেকে সব ধরনের ইঞ্জিন বিশিষ্ট অটোরিকশা (বেবি ট্যাক্সি) নিষিদ্ধ করা হয়। এখন ঢাকায় শুধুমাত্র সবুজ রঙ করা সিএনজি চলার অনুমতি পায়,যেগুলো দুই স্ট্রোক ইঞ্জিন বিশিষ্ট, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও মিটার বসানো থাকে। সবুজ রঙয়ের মাধ্যমে বোঝানো হয় যে সিএনজি হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব।

টুকটুক দেখতে খুবই আকর্ষণীয়।

কম্বোডিয়া: কম্বোডিয়াতে মোটরসাইকেলের সাথে যাত্রী বসানোর সীট থাকে। এখানে প্রায় ৬,০০০ এর বেশী টুকটুক রিকশা চলে।

ইন্ডিয়া ইন্ডিয়াতে দুই ধরনের অটোরিকশা দেখা যায়। একটিতে ড্রাইভারের সীটের নিচে ইঞ্জিন থাকে আর আরেকটায় ইঞ্জিন থাকে পেছনে। ইন্ডিয়া জনসংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশী ও বড় একটি দেশ, প্রায় ১.৫ মিলিয়ন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ইন্ডিয়াতে চলে।

পাকিস্তান পাকিস্তানে বেশিরভাগ জায়গায় এই অটোরিকশা চলে। সাধারনত কাছাকাছি কোথাও যাওয়া আসার জন্য এই যানটি বেশী জনপ্রিয়। পাকিস্তানিরা এই যানটিকে ’চান্দ গাড়ি’ অর্থাৎ ‘চাঁদের গাড়ি’ বলে। পাকিস্তানের রাজধানীতে রিকশা চলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু অন্যান্য স্থানে রিকশা আর অটোরিকশা  চলে।

ফিলিপাইন টুকটুক অটোরিকশাগুলো ফিলিপাইনে সবথেকে বেশী জনপ্রিয় একটি বাহন। ফিলিপাইনে বিভিন্ন রাস্তায় এই টুকটুক অটোরিকশা দেখা যায় , বিশেষ করে ম্যানিলা শহরে। বাজাজ অটো ডিলারশিপের মাধ্যমে টুকটুক অটোরিকশা সরবরাহ করে থাকে। ইংরেজি অক্ষর ‘ই’ এর মত দেখতে বলে একে ‘ই- ট্রাইক্স’ বলে।

চীন অনেক ধরনের অটোরিকশা চলতে দেখা যায় চীনে। এদের মধ্যে এই টুকটুক অটোরিকশাও চলতে দেখা যায়। তবে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চীনে বেশিরভাগ জায়গায় অটোরিকশা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কা: শ্রীলঙ্কায় টুকটুক অটোরিকশা খুবই জনপ্রিয় একটি যান। এতে তারা নিজেরা চলাফেরা করে, দূরের কাছের যাত্রীদের আনা নেওয়া করে। এমনকি বিদেশী পর্যটকদেরও নিয়ে ঘোরায় শ্রীলাঙ্কানরা। ২০০৬ সালে পরিবেশ দূষণ রোধে শ্রীলঙ্কান সরকার এই তিন চাকা বিশিষ্ট ইঞ্জিন চলিত ‘ট্রিকশা’ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন।

আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে অটোরিকশা

মিশরের রাস্তায় অটোরিকশা।

মিশর মিশরে কিছু স্থানীয় এলাকায় এই টুকটুক রিকশা ব্যবহার করা হয়। যদিও ইদানিং ভাবা হচ্ছে এই অটোরিকশাগুলোকে অপসারন করে মিনিভ্যান নামানো হবে।

ফিলিস্তিন ২০১০ এর পর থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় সব ধরনের প্রানীচালিত যানবাহনের পরিবর্তে টুকটুক রিকশার ব্যবহার শুরু হয়।

মাদাগাস্কার এখানে অনেক শহুরে মানুষের মধ্যে রিকশার ব্যবহার বেশী দেখা যেত তবে বর্তমানে টুকটুকের ব্যবহারও দেখা যায়।

নাইজেরিয়া কিছু অটোরিকশা এখানে চোখে পড়ে এগুলোকে ‘কেকে’ বলা হয়ে থাকে। তবে নাইজেরিয়ার বড় রাস্তায় এসব অটোরিকশাগুলোর চলার অনুমতি নেই।

দক্ষিণ আফ্রিকা  দক্ষিন আফ্রিকার মানুষ এই টুকটুক রিকশা খুব আনন্দের সাথে ব্যবহার করে , বিশেষ করে মুদির দোকানিরা ।

তানজানিয়া তানজানিয়াতে এই রিকশাগুলো ‘বাজাজি’ নামে পরিচিত।

সুদান সুদানে এসব রিকশাকে মানুষ ‘রাকশা’ বলে। শহরের আশে পাশে বেশিরভাগ জায়গায় ব্যবহৃত হয়।

জিম্বাবুয়ে ‘হেন্ডে মটো’ সর্বপ্রথম জিম্বাবুয়েতে তিন চাকার এই যানটি তৈরি করে। এই গাড়িগুলোর বডিতে সাফারি ফাইবার গ্লাস থাকে। এই তিন চাকার গাড়ীগুলো সাধারনত গ্রামে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হত।

বাহারি রঙের ‘টুকটুক’।

ইউরোপ

ফ্রান্স প্যারিসে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য বেশ কিছু টুকটুক অটোরিকশা রয়েছে। এরমধ্যে কিছু প্যাডেল আর কিছু আছে ইঞ্জিন চালিত।

ইটালি অটোরিকশাগুলো ইটালিতে অনেক যুগ ধরে ব্যবহার চলে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এই টুকটুক অটোরিকশা ইটালিতে চলে। এখনো ইটালির বেশ কিছু জায়গায় টুকটুক বেশ জনপ্রিয়।

যুক্তরাজ্য  ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যে টুকশপ নামে একটি দোকানে টুকটুক অটোরিকশাগুলো ভাড়া ও বিক্রির কাজ শুরু করা হয়। তখন থেকেই যুক্তরাজ্যেও টুকটুক অটোরিকশা পরিচিতি লাভ করে।

২০০৬ সালে অটোরিকশাতে ভ্রমণ করে গিনিস ওয়ার্ল্ড বুকে নাম লেখান ব্রিটিশ ভ্রমণ লেখিকা ‘অ্যান্টোনিয়া বোলিংব্রোক কেন্ট’ এবং তার বন্ধু ‘জো হাক্সস্টার’।তারা ব্যাংকক থেকে ব্রাইটন প্রায় ১২,৫৬১ মাইল অটোরিকশায় ৯৮ দিন ভ্রমণ করেন।তারা চায়না, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, কাযাখস্থান দেশগুলো অতিক্রম করেন। চায়না অতিক্রমের সময় এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের সম্মুখীন হন। তারা যে গোলাপি অটোরিকশায় ভ্রমণ করেন তার নাম ছিল ‘টিং-টং’।

অ্যান্টোনিয়া বোলিংব্রোক কেন্ট’ এবং তার বন্ধু ‘জো হাক্সস্টার’।

আমেরিকা

এল সেলভেটর টুকটুক অটোরিকশার আরেকটি সংস্করন হচ্ছে মটোট্যাক্সি ,যা এল সেলভেটরে জনপ্রিয়। এগুলোর সাথে ইন্ডিয়ান বাজাজ ব্র্যান্ডও ছিল।

গুয়েতেমালা  ফ্লোরস পেটেন, অ্যান্টিগুয়া গুয়েতেমালা  এসব ছোট ছোট পাহাড়ের শহরে টুকটুক গাড়ির ব্যবহার দেখা যায় ।

যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬০ সালে ইউনাইটেড স্টেটে চিঠি প্রেরনের কাজে ব্যবহৃত হত এই টুকটুক অটোরিকশাগুলো।

কিউবা কিউবাতে এই টুকটুক রিকশাগুলো অনেকটা নারিকেলের মত দেখতে ছিল বলে এগুলোকে ‘কোকো ট্যাক্সি’ বলা হত ।

কিউবার ‘কোকো ট্যাক্সি’।

পেরু পেরুতে এই টুকটুক অটোরিকশার আরেকটি সংস্করণ চলে তাকে ’মটো ট্যাক্সি’ বলে ।

অটোরিকশাগুলো মানুষের কাছে অনেক জনপ্রিয়, তাই এই অটোরিকশাগুলোর উন্নত করা নিয়ে অনেক কাজ করা হচ্ছে।বিভিন্ন দেশে অটোরিকশাগুলোকে সেলফ ড্রাইভিং অটোরিকশায় পরিণত করবার চেষ্টা চলছে। অটোরিকশা একটি শহরের পূর্ণতা হলেও এর পার্কিং ও যেখান সেখান থেকে যাত্রী ওঠানোর জন্য রাস্তায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। সবশেষে এটাই বলা যায় যে, টুকটুক অটোরিকশাগুলো সহজলভ্য ও সার্বজনীন হওয়াতে এর জনপ্রিয়তা সবসময়ই বেশী।

    গাড়ির সুরক্ষায় প্রহরী সম্পর্কে জানতে

    Share your vote!


    এই লেখা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
    • Fascinated
    • Happy
    • Sad
    • Angry
    • Bored
    • Afraid

    মন্তব্যসমূহ

    Scroll to Top